নড়াইল: এক সময় গ্রাম্য মানুষের বিনোদনের অন্যতম উপকরণ ছিল লাঠি খেলা। কিন্তু কালের বির্বতনে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রাম বাংলার জনপ্রিয় ঐতিহ্যবাহী এ খেলাটি। যথাযথ মূল্যায়ণ না করা এবং আর্থিক সংকটের কারণে খেলোয়ারা আজ বিমুখ খেলাটি থেকে! তাছাড়া দিন দিন অপসংস্কৃতি ঢুকে পড়ায় খেলাটি হারিয়ে যেতে বসেছে। লাঠি খেলুড়ে বলিষ্ঠ ব্যক্তিদের বলা হয় লাঠিয়াল।
আবহমানকাল ধরেই নড়াইল সদর উপজেলার বাস গ্রাম, বগড়ো, ভদ্র বিলা, আগদিয়া , বেছালীসহ পাশ্ববর্তী বিভিন্ন গ্রামগুলোতে বিনোদনের খোরাক জুগিয়েছে লাঠিখেলা। বাঙালির বর্ষবরণ, বিবাহ ও নবান্ন উৎসব উপলক্ষে লাঠি খেলার আয়োজন করতেন গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষ। ঢোল, কাশি আর লাঠির তালে তালে নাচা-নাচি করে মেতে থাকতো লাঠিয়ালরা। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে লাঠি খেলা নিয়ে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। কিন্তু লাঠি খেলায় নতুন করে কোন সংগঠন বা দল তৈরি হচ্ছে না। যার ফলে হারিয়ে যেতে বসেছে খেলাটি। গ্রাম বাংলাতে বিভিন্ন ধরনের লাঠি খেলা রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম সড়কি খেলা, ফড়ে খেলা, ডাকাত খেলা, বানুটি খেলা, গ্রুপ যুদ্ধ, নরি বারী খেলা এবং দা খেলা (ধারালো অস্ত্র দিয়ে উপহাস যুদ্ধ) ইত্যাদি।
প্রতিপক্ষের হাত থেকে আত্মরক্ষার কৌশল অবলম্বনের প্রচেষ্টা সম্বলিত টান টান উত্তেজনার একটি খেলার নাম লাঠি খেলা। এ খেলাটি মূলত ঐতিহ্যগত মার্শাল আর্ট, ঢাকের বাজনা এবং লাঠির সংমিশ্রণ। খেলাটির জন্য সাড়ে চার থেকে পাঁচ ফুট লম্বা লাঠি প্রয়োজন হয় তবে তা সাধারণত তৈলাক্ত হয়। প্রত্যেক খেলোয়াড় তাদের নিজ নিজ লাঠি দিয়ে রণকৌশল প্রদর্শণ করেন। শুধু বলিষ্ঠ যুবকেরাই এই খেলায় অংশ নিতে পারে। লাঠিখেলার আসরে লাঠির পাশাপাশি যন্ত্র হিসেবে ঢোলক, কনের্ট, ঝুমঝুমি ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়। সঙ্গীতের পাশাপাশি চুড়ি নৃত্যও দেখানো হয়।
এ খেলার বিষয়ে উপজেলার হাতিয়াপাড়া গ্রামের হাসিবুল হাসান শান্ত জানান, ‘গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী এ লাঠি খেলা আজ বিলুপ্ত প্রায়। খেলোয়াড়রা এখন আর আগের মতো আগ্রহ প্রাকাশ করে খেলা করে না। তাদেরকে মূল্যায়ণ করা হয় না। অর্থিকভাবেও সহায়তা করা হয় না। যার ফলে নতুন দল বা সংগঠন তৈরি হচ্ছে না।’
গত দশকগুলোতেও গ্রামাঞ্চলের লাঠি খেলা বেশ আনন্দের খোরাক জুগিয়েছে। সাধারণ মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছিল এ খেলাটি। দুর-দুরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসতো খেলা দেখার জন্য। বিভিন্ন জায়গায় মাঝে মধ্যে এ লাঠিখেলা দেখা গেলেও তা খুবই কম। খেলাটি দিন দিন বিলুপ্ত হচ্ছে বিধায় খেলোয়াড় সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। নির্মল বিনোদনের খোরাক আর গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য এ লাঠি খেলাটি আর চোখে পড়ে না বললেই চলে।
এ ব্যাপারে নড়াইল সদর উপজেলার ভদ্র বিলা ইনিয়ানের বাগডাং গ্রামের আকতার হোসেন মোল্যা জানান, মানুষ যখন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে হারিয়ে ফেলে তখন সমাজে অপসংস্কৃতি ঢুকে পড়ে। এটা আমাদের দেশেও ঘটছে। আমাদের ছেলে মেয়েরা দেশি খেলাধুলা ভুলতে বসেছে। আমরা দিন দিন অপসংস্কৃতির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছি। লাঠিখেলা আমাদের দেশের ঐতিহ্যবাহী একটি খেলা, যা আজ বিলুপ্ত প্রায়। এ ঐতিহ্য রক্ষায় সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.