তুরস্কের সমুদ্র সৈকতে নিথর পড়ে থাকা তিন বছর বয়সী শিশু আয়লান কুর্দির ছবি গোটা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম থেকে শুরু করে বিশ্বব্যাপী সব দেশেরই মূলধারার গণমাধ্যমে দিনের পর দিন শিরোনাম ছিল ওই ছবি। বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের ভয়াবহতা আর শরণার্থীদের দুঃখ-দুর্দশা উঠে এসেছিল ওই একটিমাত্র ছবিতে। তারপর দেখতে দেখতে কেটে গেছে একটি বছর। আয়লান কুর্দির ওই ছবি যেভাবে সাড়া ফেলেছিল বিশ্বব্যাপী তার কি আদৌ কোনো প্রভাব পড়েছে বিশ্ব বাস্তবতায়? সিরিয়ার যুদ্ধে কি আদৌ কোনো প্রভাব রাখতে সমর্থ হয়েছে বিশ্ববিবেককে নাড়া দেয়া ওই ছবি? আয়লান কুর্দির বাবা আবদুল্লাহ কুর্দি অভিযোগ করেছেন, সিরিয়ার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে বিশ্ব। আর এখনও নিহতের মিছিল বেড়েই চলেছে সিরিয়ায়। তিনি নিজ দেশ সিরিয়ায় চলমান রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বন্ধ করার জন্য কাজ করতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি অনুরোধ করেছেন। বলেছেন, আয়লান কুর্দির মৃত্যুর ঘটনায় তার পরিবার যতটা মনোযোগ পেয়েছে, তা কাউকেই রক্ষা করতে পারেনি। বৃটিশ টেলিগ্রাফের খবরে বলা হয়, গত বছরের সেপ্টেম্বরে আবদুল্লাহ কুর্দি তার স্ত্রী রেহানা ও দুই সন্তানকে নিয়ে সমুদ্রপথে যাত্রা করেছিলেন ইউরোপের দিকে। ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবির ঘটনার শিকার হন তারা। আর তাতেই ২রা সেপ্টেম্বর নিহত হয় আয়লান। তুরস্কের সমুদ্র সৈকতে পড়ে থাকে লাল রঙের টি-শার্ট আর ডেনিমের শর্টস পরা আয়লানের নিথর দেহ। হৃদয়বিদারক ওই ছবি যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার শরণার্থীদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্রপথে যাত্রার চিত্র তুলে ধরে। আবদুল্লাহ কুর্দি জার্মান সংবাদপত্র বিল্ডকে বলেন, তার মৃত শিশুর ওই ছবি প্রকাশ হওয়ার অধিকার রাখে। তার ভাষ্য, ‘এ ধরনের বিষয় মানুষকে দেখানো প্রয়োজন যাতে তারা এটা স্পষ্ট বুঝতে পারে যে কী ঘটছে। কিন্তু শেষ বেলায় ওই ছবি বড় কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। সিরিয়ার চলমান বিভীষিকা শেষ পর্যন্ত বন্ধ হতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমার পরিবারের সদস্যদের মৃত্যুর পর রাজনীতিবিদরা বলেছিলেন, এমনটি আর কখনই হবে না। প্রত্যেকেই দাবি করেছিলেন, ওই ছবি তাদের গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে এবং তারা কিছু না কিছু করতে চান। কিন্তু এখন কী ঘটছে? এখনও মানুষ মরেই চলেছে এবং এটা নিয়ে কেউই কোনোকিছু করছে না।’ ইরাকি কুর্দিস্তানের রাজধানী এরবিলে নিজ বাসায় বসে কথা বলছিলেন আবদুল্লাহ কুর্দি। আয়লানের স্মৃতিকে জাগরূক রাখার জন্য তার সব খেলনা তিনি বসার ঘরে সাজিয়ে রেখেছেন। তিনি বলেন, এখন সম্ভবত আমি আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় নিরাপদে রয়েছি। কিন্তু কিসের জন্য? ওই ছবি শরণার্থী সংকট নিয়ে চলমান বিতর্ককে একটি কাঠামো দিতে সহায়তা করেছি। শরণার্থীদের জন্য জার্মানির দরজা খোলা রাখতে দেশটির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের সিদ্ধান্তেও ভূমিকা রেখেছিল ওই ছবি। মার্কেলের ওই সিদ্ধান্তে চমকিত হয় বিশ্ব এবং কৃতজ্ঞ শরণার্থীরা জার্মান নেতাকে ‘মামা মার্কেল’ বলে স্তুতিতে ভাসায়। দেশের মধ্যেই ব্যাপক চাপের মুখে থাকলেও এবং তার গ্রহণযোগ্যতা কমা সত্ত্বেও মার্কেল এ সপ্তাহেও বলেছেন, শরণার্থী ইস্যুতে নেয়া তার সিদ্ধান্তের জন্য তার কোনো আক্ষেপ নেই। গত বছর আয়লান কুর্দির ছবি প্রকাশিত হওয়ার পর বৃটেনে লক্ষাধিক মানুষ রাস্তায় নেমে আসে এবং বৃটেনে শরণার্থীদের স্বাগত জানানোর আহ্বান জানায় সরকারের প্রতি। এর প্রেক্ষিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনকে প্রতিশ্রুতি দিতে হয় যে বৃটেন প্রতি বছর সিরিয়া থেকে আগত ৪ হাজার শরণার্থীকে আশ্রয় দেবে। এই লক্ষ্য অবশ্য এখনও পূরণ হয়নি। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইউকে’র শরণার্থীবিষয়ক কর্মসূচির পরিচালক স্টিভ সায়মন্ডস বলেন, ‘তুর্কি সমুদ্র সৈকতে মৃত আয়লান কুর্দির পড়ে থাকার ছবি প্রকাশের এক বছর পরও হাজার হাজার শরণার্থী ভূমধ্যসাগর ও এজিয়ান সাগরে প্রাণ হারাচ্ছে। এ বিষয়ে জনপ্রতিবাদ একটি রাজনৈতিক বাঁকবদল তৈরি করতে পারত। কিন্তু আয়লান কুর্দির মৃত্যুর পর বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত বিপর্যয়কর।’ তুরস্ক ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) চুক্তির আওতায় ইউরোপে শরণার্থীদের প্রবেশ সীমিত করা হয়েছে। কিন্তু ওই চুক্তির বাস্তবায়নে দেরি হওয়ার কারণে হাজার হাজার শরণার্থী গ্রিসে আটকা পড়ে। গতকালও দেশটিতে শরণার্থী ও অভিবাসীরা বিক্ষোভ করেছে। গ্রিসের কিওস দ্বীপে বিক্ষোভকারীরা টাউন হল অভিমুখে যাত্রা করে। তাদের মধ্যে এক তরুণের বুকে কমলা রঙে লেখা ছিল, ‘শিশুদের ভবিষ্যতের অধিকার রয়েছে’। সিরিয়ায় চলমান সংঘর্ষ ছয় বছরে পা দিয়েছে। আয়লানের মৃত্যুর পর কেবল দেশটির যুদ্ধ পরিস্থিতির অবনতিই হয়েছে। এর মধ্যে আরো একটি তিন বছর বয়সী সিরিয়ান শিশুর ছবি ভাইরাল হয়ে পড়েছে। আলেপ্পোতে যুদ্ধবিধ্বস্ত ভয়াবহ একটি পরিস্থিতিতে ওই শিশুটি যেন স্তম্ভিত ও বিধ্বস্ত। ওমরান দাকনিশ নামের ওই শিশুর ছবিটি তোলা হয়েছে গত মাসে। এক বিমান হামলার শিকার হয় ওমরানদের বাড়ি। তাতে আহত হয় ওমরান। অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল হাসপাতালে। এ সময় স্তম্ভিত ওমরান নিজের মুখে হাত দিলে হাতে উঠে আসে রক্ত। চমকে ওঠে সে। সেই ছবিটিই ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী। ওই হামলায় ওমরান বেঁচে গেলেও তার ১০ বছর বয়সী বড় ভাই আলি বাঁচতে পারেনি। আয়লান কুর্দির মৃত্যুর প্রায় এক বছর পর ওমরান আবার নাড়িয়ে দিয়েছে বিশ্বকে। কিন্তু আয়লানের বাবার আবদুল্লাহ যেমন বলছেন- তার ছেলের মৃত্যু কিছুই বদলাতে পারেনি, ওমরানের ছবিও কি কোনো পরিবর্তন আনবে সিরিয়ার যুদ্ধ পরিস্থিতিতে? সিরিয়ায় ছয় বছর ধরে চলছে যুদ্ধ। দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ আর বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে চলমান এই যুদ্ধে জিম্মি হয়ে পড়েছেন প্রায় ২০ লাখ মানুষ। এই যুদ্ধে এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন চার লাখেরও বেশি মানুষ। দেশটির দুই কোটি ২০ লাখ জনগণের অর্ধেকেরও বেশি এখন হয় শরণার্থী, নয়তো উদ্বাস্তু হয়ে পড়েছেন। এই যুদ্ধের অবসান ঘটাতে এখন পর্যন্ত নেয়া সব কূটনৈতিক উদ্যোগই ব্যর্থ হয়েছে। বিশ্বের প্রধান প্রধান ক্ষমতাধরদের মধ্যকার আলোচনাতেও কাটেনি অচলাবস্থা।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.