বর্তমান মার্কিন বিদেশমন্ত্রী জন কেরি বিএনপি নেত্রীকে সাক্ষাৎদান করেছেন, তাতে আপত্তি জানানোর কিছু নেই। বিএনপি নেত্রী তার কাছে বাংলাদেশে গণতন্ত্র নেই বলে যে কাঁদুনে গেয়েছেন, তাতেও না হয় আপত্তি না জানানো গেল। কিন্তু বিএনপি যখন বলে, তারা আমেরিকার সাহায্যে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে, তখন শঙ্কিত হতে হয়। বিএনপি কি গণতন্ত্রের পথে ফিরে না এসে, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথে না এগিয়ে আবার ষড়যন্ত্রের পথে হাঁটতে চায় এবং সেই ষড়যন্ত্রে আবারও বিদেশি শক্তিকে জড়াতে চায়? তারা জড়াতে চাইলেই আমেরিকা বা অন্য কোনো বড় দেশ এই ষড়যন্ত্রে জড়াতে চাইবে- সেই বিশ্ব পরিস্থিতি এখন নেই। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বিদেশি শক্তিকে জড়ানোর এই চেষ্টা তো বিএনপির দেশপ্রেমের পরিচয় বহন করে না।
হাসিনা সরকার বর্তমান পরিস্থিতিতে যে ধরনের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশ পরিচালনা করছে, তাতে বিএনপি বা তার সমমনা অন্যান্য দল ও একটি তথাকথিত সুশীল সমাজের আপত্তি থাকতে পারে। তারা সেই আপত্তির ভিত্তিতে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় দেশে জনমত গড়ে তুলতে পারেন, আন্দোলনে নামতে পারেন। সে রাস্তা তো তাদের জন্য খোলা। দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আছে। আমি বলব, একটু বেশিই আছে। সরকারের সমালোচনা করার অধিকারও কেড়ে নেওয়া হয়নি। কেড়ে নেওয়া হলে খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে মির্জা ফখরুল, রিজভী পর্যন্ত নেতারা নিত্য সভা ডেকে আবোল-তাবোল বকেন কীভাবে? আর একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের দণ্ড দেওয়া হলেই যদি বিএনপি বলে, দেশে মানবতাবিরোধী কার্যকলাপ চলছে এবং সন্ত্রাসী ধরা হলেই যদি দাবি করা হয়, এরা সবাই বিএনপির নেতাকর্মী, তাহলে সরকারকে তো এই ভয়াবহ সন্ত্রাস দমনের অভিযান বন্ধ রাখতে হয়। আর সব সন্ত্রাসীই যদি বিএনপির নেতাকর্মী হয়, তাহলে এই দলের আসল চরিত্রটাই-বা কী?
বিএনপির প্রবীণ শুভানুধ্যায়ীরা এমনকি ড. এমাজউদ্দীনের মতো ব্যক্তি পর্যন্ত খালেদা জিয়ার কাছে সকাতর অনুরোধ জানাচ্ছেন, বিএনপি যাতে স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতক ও দালালের দল জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। বিএনপি গণতন্ত্র ও স্বাধীনতাপ্রেমী দল হলে জামায়াতের মতো সন্ত্রাসী ও দেশদ্রোহী দলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে পারে না। কিন্তু দলের ভেতরে ও বাইরে এ সম্পর্কে অসন্তোষ পুঞ্জীভূত হওয়া সত্ত্বেও দলনেত্রী সেদিকে নজর দিচ্ছেন না। পুত্র তারেক রহমানের পরামর্শে এই সম্পর্ককে রক্ষা করে চলেছেন। বর্তমানে বিএনপি নেত্রী নতুন কৌশল গ্রহণ করেছেন। বাইরে ভাব দেখাচ্ছেন, জামায়াতের সঙ্গে তার দল ক্রমশ দূরত্ব বাড়িয়ে চলেছে। কিন্তু জামায়াতের সঙ্গে তার দলের অপ্রকাশ্য গাঁটছড়া এখনও ছিন্ন হয়নি। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেমের দণ্ডাদেশ ঘোষিত হওয়ার পর বিনেপির ভূমিকা তা আরও ভালোভাবে প্রমাণ করে।
দেশে জামায়াতের সঙ্গে দল পাকিয়ে এই দণ্ডাদেশগুলোর বিরুদ্ধে আন্দোলনে প্রকাশ্যে না নামলেও বিদেশে জামায়াতিদের এই আন্দোলনে পুরোভাগে থাকে বিএনপি। মীর কাসেমের দণ্ডাদেশ ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লন্ডনে আলতাফ আলী পার্কে জামায়াত এক প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে। তাতে বিএনপির লোকজন তো ছিলই, সমাবেশে নেতৃত্ব দেন তারেক রহমানের ডান হাত যুক্তরাজ্য বিএনপির নেতা। তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘এটা জামায়াতিদের সমাবেশ নয়। বাংলাদেশিদের সমাবেশ। বাংলাদেশে মানবতা এখন নির্যাতিত। তারই প্রতিবাদে এই সভা ডাকা হয়েছে।’
লন্ডনের বাংলা মিডিয়া যে তার কথা বিশ্বাস করেনি তার প্রমাণ, তাদের অধিকাংশই এটাকে জামায়াতি সমাবেশ বলে তাদের খবরে উল্লেখ করেছে। এক সাংবাদিক প্রশ্ন রেখেছিলেন, এটা যদি জামায়াতের সমাবেশ না হবে, তাহলে জামায়াত নেতা এবং ‘৭১-এর যুদ্ধাপরাধীর দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে এই সমাবেশে বিএনপির নেতাকর্মীদের দেখা যাচ্ছে কেন? এই প্রশ্নের কোনো জবাব মেলেনি। বিএনপি রাজনীতির সবচেয়ে ভণ্ডামির দিক হচ্ছে- দলটি বলছে, তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়। অথচ ‘এই বিচারে স্বচ্ছতা নেই’- ধুয়া তুলে তারা মানবতার নামে মানবতার এই জঘন্য শত্রুদের দণ্ডদানের বিরোধিতা করে চলছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠী (নেপথ্যে জামায়াত) যে সন্ত্রাস চালাচ্ছে, তাকে একটি জাতীয় বিপর্যয় বলা চলে। এই বিপর্যয়ে বিএনপির উচিত বিনা শর্তে সরকারের পাশে এসে দাঁড়ানো। বিএনপি তা না করে এই বিপর্যয়কেও তাদের দলীয় স্বার্থসিদ্ধির কাজে লাগাতে চাইছে এবং জাতীয় ঐক্যের নামে সরকারকে তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক সংলাপে বসার ফাঁদে ফেলতে চাইছে। সম্প্রতি খালেদা জিয়া গুলশান ও শোলাকিয়ায় সরকারের সব সন্ত্রাস দমন অভিযানেরও নিন্দা করেছেন এবং যেসব সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে তাদের জীবিত অবস্থায় ধরে বিচারে কেন সোপর্দ করা হলো না, সেই প্রশ্নও তুলেছেন।
মজার ব্যাপার এই যে, ক্ষমতায় থাকাকালে র্যাবের প্রতিষ্ঠা দ্বারা এই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ব্যবস্থাটির প্রবর্তন খালেদা জিয়াই করেছিলেন। ‘৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি যেমন তার সহানুভূতি, তেমন সহানুভূতি তার বর্তমানে নিহত সন্ত্রাসীদের প্রতিও। এরা ‘আসলে সন্ত্রাসী’ কি-না সেই বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টাও তিনি করেছেন তার সাম্প্রতিক বক্তৃতায়। রামপাল বিতর্কে তিনি সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিন, তাতে আপত্তি করার কিছু নেই। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ঘাতক, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী এবং বর্তমানের পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের হোতাদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থানকে যিনি বা যে দল বিতর্কের মুখে ঠেলে দিতে চায়, তাদের মুখে গণতন্ত্র, মানবতা, মানবাধিকার ইত্যাদি বুলি শোভা পায় কি?
বিএনপির জনবিচ্ছিন্নতা দ্রুত বাড়ছে। দলটির হাতে কোনো সুষ্ঠু রাজনৈতিক কর্মসূচি নেই। এটা তাদের সাম্প্রতিক কথাবার্তা, প্রকাশ্য সভামঞ্চে কান্নাকাটি দেখেই বোঝা যায়। পরগাছা রাজনীতির কোনো ভবিষ্যৎ থাকে না। বিএনপির জন্ম এবং ক্ষমতা দখলের পেছনে দীর্ঘকাল পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর ভূমিকা এখন সর্বজনবিদিত। পাকিস্তানের খুঁটি দুর্বল হয়ে পড়তেই বিএনপি তার ভারত-বিদ্বেষের নীতি হঠাৎ বর্জন করে মোদিপ্রেমিক হয়ে ওঠে। এই প্রেম সম্ভবত প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এখন আমেরিকার কৃপাদৃষ্টি লাভের চেষ্টা। এই পরগাছা-রাজনীতি সফল হবে না। বিএনপি যদি গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ফিরে আসতে না পারে এবং দলে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে না পারে, তাহলে মুসলিম লীগের চেয়েও এই দলটির শোচনীয় পতন অনিবার্য।
১ সেপ্টেম্বর ছিল বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ঢাকায় অধিকাংশ সংবাদপত্র এই দিবস পালনের খবর প্রকাশ করতে গিয়ে খবরের শিরানাম দিয়েছে- ‘এমন বিপদ আর কখনো আসেনি’। অর্থাৎ বিএনপি এমন বিপদের আর কখনও সম্মুখীন হয়নি। এই বিপদ বিএনপির নিজের কর্মফল। চরিত্র ও নীতি না বদলালে এই কর্মফলের ভোগান্তি থেকে দলটির মুক্তি নেই। দলের নতুন জাতীয় কর্মপরিষদ গঠনকালেও দেখা গেছে, তাতে নতুন মুখ হিসেবে যাদের আনা হয়েছে তাদের অধিকাংশই অতীতের যুদ্ধাপরাধ ও অন্যান্য অপরাধের সঙ্গে যুক্ত দলীয় নেতাদের সন্তান-সন্ততি বা আত্মীয়। বিএনপির নবজন্ম তাদের দ্বারা সম্ভব কি?
দেশের বড় দুটি দলের অন্যতম হওয়া সত্ত্বেও নিজের কর্মদোষে যদি বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি গুরুত্ব ও অস্তিত্ব হারায়, তার চেয়ে বড় রাজনৈতিক ট্র্যাজেডি আর কী হবে?
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.