শ্যামপুর এবং জিলবাংলা সুগার মিলের পরিশোধিত মূলধন মাত্র ১১ কোটি টাকা। অথচ পুঞ্জীভূত লোকসান ৪৭৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত সরকারি দুই চিনি কল কোম্পানির মূলধনের চেয়ে লোকসান ৪৪ গুণ। এছাড়াও বিভিন্ন ব্যাংকে খেলাপি ঋণ রয়েছে ২২৭ কোটি টাকা, যা মূলধনের চেয়ে ২১ গুণ বেশি। অ্যাকাউন্টিং স্ট্যান্ডার্ড অনুসারে প্রতিষ্ঠান দুটি দেউলিয়া।
আখচাষীদেরও বিপুল অংকের পাওনা রয়েছে। প্রতিষ্ঠান দুটির সম্পদের চেয়ে দায় বেশি। চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের আওতাধীন এ কোম্পানি দুটি ১০ বছরেও বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দিতে পারেনি। অথচ এরপরও প্রতিষ্ঠান দুটির শেয়ারের দাম বাড়ছেই। গত ৬ মাসে এ দাম বাড়ার হার ১৭০ শতাংশ। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের দাম কেন বাড়ছে তার কোনো সন্তোষজনক জবাব মেলেনি।
সূত্রমতে, জেড ক্যাটাগরির এসব শেয়ারে বিনিয়োগ করে ক্রেতারা সর্বস্বান্ত হলেও নিয়ন্ত্রক সংস্থার কোনো ভূমিকা নেই। জিলবাংলা সুগার মিলের ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ারের বিপরীতে ঋণের পরিমাণ ২০৮ টাকা। প্রতিটি শেয়ারের বর্তমান বাজারমূল্য ১৮ টাকা। অর্থাৎ যে বিনিয়োগকারী শেয়ারটি কিনছেন, তিনি ১০ টাকা খরচ করে ২০৮ টাকা ঋণের দায় নিলেন। একইভাবে শ্যামপুর সুগার মিলের ১০ টাকা মূল্যের শেয়ারের বিপরীতে ঋণ দাঁড়ায় ২০৪ টাকা। এভাবে বিনিয়োগকারীদের অজ্ঞাতেই প্রতিষ্ঠানের দায়ভার তাদের ওপর পড়ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বেসরকারি কোম্পানির সিন্ডিকেট ভেঙে সাধারণ মানুষের কাছে কম দামে চিনি বিক্রি করতে এসব প্রতিষ্ঠান গঠন করেছিল সরকার। কিন্তু সরকারের ওই উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়েছে। উল্টো বিভিন্ন ব্যাংকের টাকা আটকে রেখে মুদ্রা বাজারে সংকট সৃষ্টি করেছে। পাশাপাশি লোকসানের কারণে বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দিতে পারছে না কোম্পানিগুলো।
জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, যে উদ্দেশ্যে সরকারি কোম্পানি গঠন করা হয়েছিল, তা সফল হয়নি। কারণ লোকসান বৃদ্ধির অর্থ হল বাজার প্রতিযোগিতায় বেসরকারি কোম্পানির তুলনায় পিছিয়ে পড়ছে এসব কোম্পানি। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ বাড়ছে। অর্থাৎ মুদ্রা এবং পুঁজি উভয় বাজারে সংকট সৃষ্টি হচ্ছে।
তিনি বলেন, এসব প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজমেন্ট ভেঙে দেয়া উচিত। তা না হলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। তিনি আরও বলেন, শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য এই ধরনের চর্চা নেই।
জানা গেছে, ১৯৮৮ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় জিলবাংলা সুগার। জেড ক্যাটাগরির এ প্রতিষ্ঠানটির সর্বশেষ লোকসানের পরিমাণ ২০৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে গত অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে লোকসান ২৪ কোটি ১৬ লাখ টাকা। এ সময়ে প্রতি শেয়ারের বিপরীতে লোকসান ৪০ টাকা ২৭ পয়সা। আর ২০১৫ সালে প্রতি শেয়ারের বিপরীতে লোকসান ছিল ৫৬ টাকা ৮৯ পয়সা।
আশ্চর্যজনক হল প্রতিষ্ঠানটির সম্পদ মূল্য নেতিবাচক। ১০ টাকার প্রতি শেয়ারের বিপরীতে সম্পদ লোকসান ৩৩৩ টাকা। এছাড়া ৬ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের এ প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ১২৫ কোটি টাকা।
অন্যদিকে ১৯৯৬ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় শ্যামপুর সুগার মিল। মাত্র ৫ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের এ প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান লোকসানের পরিমাণ ২৭০ কোটি টাকা। এর মধ্যে গত অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে লোকসানের পরিমাণ ২৫ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। এ সময়ে প্রতি শেয়ারের বিপরীতে লোকসান ৫১ টাকা ৭২ পয়সা। ২০১৫ সালে প্রতি শেয়ারের বিপরীতে লোকসান ছিল ৬৭ টাকা ৫২ পয়সা।
এছাড়া ১০ টাকার প্রতিটি শেয়ারের বিপরীতে সম্পদ মূল্য লোকসান ৫২৯ টাকা। আর প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের সর্বশেষ মূল্য ১৫ টাকা। অর্থাৎ ১৫ টাকায় যে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার কিনছেন, তার কাঁধে ৫২৯ টাকার দায় চাপছে। বর্তমানে শ্যামপুর সুগারের ব্যাংক ঋণ ১০২ কোটি টাকা।
জানতে চাইলে চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান একেএম দেলোয়ার হোসেন বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, অস্বীকার করা যাবে না যে আমাদের অনেক লোকসান রয়েছে। তবে ইতিবাচক দিক হল লোকসানের কারণ আমরা চিহ্নিত করেছি। মূল কারণ চাহিদা অনুসারে আমরা বাজারে চিনি বিক্রি করতে পারছি না। আখচাষীদেরও পাওনা রয়েছে। এ কারণে তারাও চিনি উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল আখ চাষে আগ্রহী নয়।
দেলোয়ার হোসেন বলেন, আমরা চাষীদের উৎসাহিত করার চেষ্টা করছি। কোম্পানির পরিচালন ব্যয়ও কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। সবকিছু মিলে আমরা লোকসান কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.