যুদ্ধাপরাধী ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের আলবদর কমান্ডার মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। শনিবার রাত ১০টা ৩০ মিনিটে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
দিনের বেলাতেই ফাঁসি কার্যকরের যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করে কারা কর্তৃপক্ষ। সকালে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২-এ সামিয়ানা টানিয়ে এবং ফ্লাডলাইট জ্বালিয়ে প্রস্তুত করা হয় ফাঁসির মঞ্চ। এর আগে মোম মাখানো দড়িতে বালুর বস্তা ঝুলিয়ে ফাঁসির মহড়াও দেয়া হয়।
শুক্রবার সকাল থেকেই কারাগার এলাকায় গড়ে তোলা হয় ছয় স্তরের নিরাপত্তা বলয়। বৃহস্পতিবার বিকালেই কাশিমপুর কারাগারের মূল প্রবেশ পথের দোকানপাটগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। কারাগারের মূল সড়ক থেকে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের সংযোগ পর্যন্ত অংশে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়।
কারাগারের চারপাশে মোতায়েন করা হয় কারারক্ষী, অতিরিক্ত পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের। রাজধানী ঢাকা ও গাজীপুর মহানগরীর বিভিন্ন স্থানেও জোরদার করা হয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
এছাড়া জামায়াত অধ্যুষিত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মোতায়েন করা হয় বিজিবিসহ আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের। শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ ও কাশিমপুর কারা ফটকে মুক্তিযোদ্ধা ও উৎসুক জনতা অবস্থান নেন। ফাঁসি কার্যকরের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তারা উল্লাস প্রকাশ করেন।
কারা সূত্র জানায়, আদালতের রায় বাস্তবায়নের জন্য শনিবার সকালে জরুরি বৈঠকে বসেন কারা অধিদফতরের কর্মকর্তারা। সেখানে আইজি (প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিনের সভাপতিত্বে কারা অধিদফতর ও কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
দুপুর দেড়টায় অতিরিক্ত আইজি (প্রিজন) কর্নেল ইকবাল হাসান ফাঁসি সংক্রান্ত নির্বাহী আদেশের কপি নিয়ে কাশিমপুর কারাগারে প্রবেশ করেন। নির্বাহী আদেশের আরেকটি কপি প্রায় একই সময়ে গাজীপুর জেলা প্রশাসকের কাছে যায়। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ফাঁসির আদেশের কপি কাশিমপুর কারাগারে পৌঁছানো হয়।
বিকাল পৌনে ৫টায় ডিআইজি গোলাম হায়দার কাশিমপুর কারাগারে প্রবেশ করেন। আর সন্ধ্যা ৬টা ৫৫মিনিটে প্রবেশ করেন আইজি (প্রিজন) বিগ্রেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন। পরে এক এক করে গাজীপুরের এসপি হারুন-অর-রশিদসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট অন্য কর্মকর্তারা কারাগারে প্রবেশ করেন।
ফাঁসির রায় কার্যকর করার সময় উপস্থিত ছিলেন- সিনিয়র জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বনিক, কারাধ্যক্ষ (জেলার) নাসির উদ্দিন আহমদ, গাজীপুর জেলা প্রশাসক এস এম আলম, জেলা পুলিশ সুপারের প্রতিনিধি সার্কেল এএসপি মনোয়ার হোসেন, জয়দেবপুর থানার ওসি খন্দকার রেজাউল হাসান, গাজীপুর জেলা সিভিল সার্জন ডা. আলী হায়দার খান, কারা হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. আহসান হাবীব।
শনিবার সকালে পুরো ফাঁসির মঞ্চে লাল ও সবুজ রঙের শামিয়ানা টানিয়ে দেয়া হয়। যাতে বাইরে থেকে ফাঁসির মঞ্চ দেখা না যায়। সামিয়ানার ভেতর বসানো হয় ফ্লাডলাইট। পাশাপাশি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে বসানো হয় সিসি ক্যামেরা।
কাশিমপুর কারাগারের এই মঞ্চটির দৈর্ঘ্য ৮ ফুট এবং প্রস্থ সাড়ে ৪ ফুট। ফাঁসির মঞ্চটি ভ‚মি থেকে বেশ উঁচু। মঞ্চের উপরে যে ফাঁসির কাষ্ঠ তার উচ্চতা ৮ ফুট। আর মঞ্চ থেকে নিচের দিকে ১২ ফুট গভীর গর্ত আছে। সেই গর্ত কাঠের পাটাতন দিয়ে ঢাকা। লিভারে চাপ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে পায়ের নিচ থেকে পাটাতন সরে যায় এবং গলায় ফাঁস পড়ে।
ফাঁসি কার্যকরের সময় মঞ্চ সংলগ্নস্থানে একটি লম্বা টেবিলে চেয়ার পাতা হয়। তাতে পাশাপাশি বসেন ১০ জন কর্মকর্তা। ২০ মিনিট ঝুলিয়ে রাখার পর ফাঁস ক‚প থেকে কাসেমের লাশ তুলে ওই টেবিলে রাখা হয়। লাশ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন সিভিল সার্জন ডা. আলী হায়দার।
বিধান অনুযায়ী মীর কাসেমের দুই পায়ের গোড়ালীর রগ কেটে দেয়া হয়। কাসেমের মৃত্যু নিশ্চিত করে সিভিল সার্জন ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ তৈরি করেন। লাশ গোসল দিয়ে কাপনের কাপড় পরানো হয়। কফিনে ভরে লাশ তোলা হয় অ্যাম্বুলেন্সে।
রায় কার্যকর করার আগে আসামি কাসেমের স্বাস্থ্য চ‚ড়ান্তভাবে পরীক্ষা করেন জেলা সিভিল সার্জন ডা. আলী হায়দার। তার সঙ্গে ছিলেন কারা অধিদফতরের চিকিৎসক ডা. আহসান হাবীব। তার (কাসেম) রক্তচাপসহ সবকিছু ঠিকঠাক থাকার পর তাকে সুস্থ বলে ঘোষণা করেন চিকিৎসকদ্বয়।
পরিবারের সদস্যরা সাক্ষাৎ করে বের হয়ে আসার পর আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে ফাঁসি কার্যকরের আগে মীর কাসেমকে গোসল করানো হয়। গোসল শেষে তওবা পড়ান কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের মসজিদের পেশ ইমাম মাওলানা হেলাল উদ্দিন।
রাত সাড়ে ৯টায় তাকে (হেলাল উদ্দিন) সঙ্গে নিয়ে জেল সুপার ও জেলার নাসির আহমদ কনডেম সেলে কাসেমের কক্ষে যান। ওইসময় কারা অধিদফতরের ডিআইজি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।
তার কাছে জানতে চাওয়া হয় তিনি কারও সঙ্গে দেখা করতে চান কি না এবং কোনো কিছু খেতে ইচ্ছে করছে কি না। তিনি বলেন, ‘না’। এরপর কাসেমকে কারাগারের জেলার বলেন, ‘এটাই আপনার শেষ রাত। এ রাতেই আপনার ফাঁসি কার্যকর করা হবে। এখন আপনাকে তওবা পড়তে হবে।’
মীর কাসেম নিজেই তওবা পড়েন। এরপর তিনি দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করেন। এর কয়েক মিনিট পর প্রধান জল্লাদের নেতৃত্বে জল্লাদরা কনডেম সেলে যান।
ফাঁসির মঞ্চে নেয়ার আগে কনডেম সেলেই কাসেমকে জম টুপি (মাথার ওপর থেকে গলা পর্যন্ত ঢেকে যায় কালো রঙের কাপড় দিয়ে তৈরি এমন বিশেষ ধরনে টুপি) পরিয়ে দেন একজন জল্লাদ। এরপর সেখান থেকে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হয়।
ফাঁসি কার্যকর করা উপলক্ষে অন্য বন্দীদের নিজ নিজ সেলে আটকে রাখা হয়। শুধু জল্লাদরা বাইরে ছিলেন। ফাঁসি কার্যকরের পর তারা নিজ নিজ সেলে ফিরে যান। কাসেমের স্বজনরা কারাগার থেকে বের হওয়ার পরই কারা ফটক ও আশপাশের এলাকা পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নেয় আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী।
এর আগে সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত কাশিমপুর কারাগার ও আশপাশের এলাকায় রেড এলার্ট জারি করা হয়। বাড়ানো হয় পুলিশি নিরাপত্তা।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.