মানবতাবিরোধী অপরাধী মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকর হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে বিবৃতি দিয়েছে, তা উদ্বেগজনক। এর মাধ্যমে দেশটির সরকার শুধু যে কূটনৈতিক শিষ্টাচার লংঘন করেছে তাই নয়, সীমাহীন ধৃষ্টতারও পরিচয় দিয়েছে। মীর কাসেমের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পরপরই পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেয়া বিবৃতিতে বলা হয়, ‘১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের আগে কথিত অপরাধের অভিযোগে ত্র“টিপূর্ণ বিচার কার্যক্রমের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের বিশিষ্ট নেতা মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকর করায় পাকিস্তান গভীরভাবে মর্মাহত।’ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একজন যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসিতে পাকিস্তানের মর্মাহত হওয়ার বিষয়টি বোধগম্য, কিন্তু তার বিচারকে ‘ত্র“টিপূর্ণ’ বলা চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ। এ ধরনের বিবৃতি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল এবং দ্বিপাক্ষিক সুসম্পর্কের পরিপন্থী। আমরা এ বিবৃতির তীব্র নিন্দা জানাই। আমরা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই, যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই এ বিচার সম্পন্ন হয়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হত্যা, গণহত্যা ও নির্যাতনের মতো গুরুতর অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকার বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে মীর কাসেমের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। এ নিয়ে ধৃষ্টতামূলক বিবৃতি প্রদানের কোনো অধিকার পাকিস্তানের নেই, বিশেষত যে রাষ্ট্রটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ।
আমরা লক্ষ করে আসছি, মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের বিচার নিয়ে পাকিস্তানের সরকার ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল শুরু থেকেই নানা আপত্তিজনক ও বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য প্রদান করে আসছে। এর আগে অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার পর পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নিসার আলী খান, পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ দলের চেয়ারম্যান ইমরান খান এবং পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামী দলের নেতারা বিভিন্ন আপত্তিকর বক্তব্য দিয়ে বিশ্বকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছেন। শুধু তাই নয়, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে প্রস্তাবও পাস করা হয়।
এসব ঘটনায় বোঝা যায়, ১৯৭১ সালে পরাজয়ের গ্লানি পাকিস্তানের এই শ্রেণীর রাজনীতিকরা এখনও ভুলতে পারেননি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এদেশে যে নজিরবিহীন বর্বরতা চালিয়েছে, এর জন্য পাকিস্তান সরকারের উচিত আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। এটি কেবল বাংলাদেশের জনগণের প্রাণের দাবি নয়, পাকিস্তানের অনেক সচেতন নাগরিকও এ বিষয়ে একমত পোষণ করেন। মীর কাসেমের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার পর পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে বিবৃতি দিয়েছে, স্বভাবতই তার তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে বাংলাদেশ। ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে তাকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। আমরা আশা করব, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ে পাকিস্তান আর নাক গলাবে না। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়াকে ত্রুটিপূর্ণ হিসেবে তুলে ধরার অপচেষ্টা থেকে তাদের বিরত থাকতে হবে। বাংলাদেশ সরকারকেও এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। অন্যদিকে বর্তমানে মানবতাবিরোধী অপরাধের যে বিচার চলছে, তা কতটা স্বচ্ছতার সঙ্গে হচ্ছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে যথাযথভাবে তুলে ধরতে হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র পক্ষের আইনি সুরক্ষার জন্য কী কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, তাও বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরা প্রয়োজন।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.