সময়ের প্রয়োজনে বিচারব্যবস্থার বিকাশ ঘটেছে, সময়ের তাগিদেই এই ব্যবস্থার পরিমার্জন-পরিবর্ধন প্রত্যাশিত। তবে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে প্রণীত অনেক আইন আমাদের দেশে অর্থহীনভাবে এখনো বলবৎ রয়ে গেছে। আইনবিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে উদ্বেগ ব্যক্ত করছেন; আইন কমিশনেরও অনেক সুপারিশ রয়েছে সংশোধনের। তবে সরকারের তরফে উদ্যোগ সন্তোষজনক নয়।
আইন যুগোপযোগী নয় বলেই অনেক ঘটনায় প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে, হয়রানির শিকার হচ্ছে নিরীহ মানুষ। অপরাধীর বিচারের জন্য আইন অথচ আইনি ফাঁক গলিয়ে অপরাধী বেরিয়ে যায়—এ বাস্তবতা বেদনাদায়ক। গতকাল কালের কণ্ঠের একাধিক প্রতিবেদনে আমাদের আইনি দুর্বলতার যে চিত্র ধরা পড়ে, তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। ব্রিটিশ আমলে প্রণীত অনেক আইন এখন অবাস্তবই শুধু নয়, মানবাধিকারের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। চাবুক আইনের মতো কিছু আইন বহু আগে বিশ্বের নানা দেশ বাতিল করলেও আমরা রেখে দিয়েছি।
দুর্বলতা রয়ে যাচ্ছে এমনকি অনেক সংশোধিত আইনেও। পুলিশ হেফাজতে আসামির মৃত্যুর ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় ২০১৩ সালে প্রণীত হয় নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন। আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা এক লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা। ফলে অপরাধী শুধু জরিমানা শোধ করে মুক্তির সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ১৮০ দিনে বিচার শেষ করতে বলা হয়েছে। কিন্তু ওই সময়ে বিচার শেষ না হলে কী হবে তা আর বলা হয়নি। আইনি দুর্বলতার এমন উদাহরণের অভাব নেই।
বিশ্বের বেশির ভাগ উন্নত দেশে নতুন আইন প্রণয়ন ও বিদ্যমান আইন সংস্কারে তাদের আইন কমিশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের আইন কমিশন অত্যন্ত শক্তিশালী। আমাদের দেশে ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর গত ২০ বছরে ১৪২টি আইন সংস্কারের সুপারিশ করেছে আইন কমিশন। এর বেশির ভাগই আমলে নেয়নি সরকার। কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করতে সরকার বাধ্য নয়। কমিশন তো গঠনই করা হয়েছে আইনকে যুগোপযোগী করার উদ্দেশ্য সামনে রেখে!
আইন মানুষের জন্য। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থ এখানে বিবেচ্য হলে উদ্দেশ্য পূরণে বিঘ্ন ঘটবেই। সভ্য, সুশৃঙ্খল, আধুনিক সমাজব্যবস্থা গড়তে চাইলে অপরাধ দমন বা নিয়ন্ত্রণের বিকল্প নেই। এ কাজে হাত গুটিয়ে বসে থাকা মানেই হচ্ছে অপরাধীদের হাতে নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেওয়া। একমাত্র শক্ত আইনি ব্যবস্থাই কোনো জাতিকে এগিয়ে নিতে পারে। এই ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার অর্থই হচ্ছে অধঃপতন। বাংলাদেশ প্রতিবছর সেরা দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকার প্রথম দিকে স্থান পায়। এ আমাদের জাতীয় লজ্জা!
আমাদের প্রত্যাশা, আইনি কাঠামোর আধুনিকায়নে প্রয়োজনীয় সব উদ্যোগ নেওয়া হবে। ক্ষমতা, রাজনীতি, গোষ্ঠী বা দলীয় স্বার্থ নয়, আইনের ব্যবহার হতে হবে কেবল মানুষের স্বার্থে। তা না হলে জাতি হিসেবে ব্যাহত হবে আমাদের অগ্রযাত্রা।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.