এবার সিডনিতে কোরবানির ঈদ কিছুটা নীরবতার মধ্য দিয়ে পালন করেছেন বাংলাদেশি মুসলিম সম্প্রদায়। কারণ সময়। এবার ঈদ ছিল সোমবার, সপ্তাহের শুরুতে। উইক এন্ড বা উইক ডের শেষদিন শুক্রবার ঈদ হলে, ঘটা করে ঈদ উদ্যাপন করা যেত। এবার একদিনের মধ্যেই ঈদের আয়োজন উদ্যাপন শেষ করতে হলো। অনেক বাংলাদেশি জামাতে ঈদের নামাজ পড়ে দু-এক চামচ সেমাই বা মিষ্টান্ন মুখে দিয়ে কাজে গেছেন। আমার কথা অবশ্য আলাদা।
যখন ঢাকায় ছিলাম, সে সময় কোরবানির গরু কেনা, ঈদের দিন নামাজের পর কোরবানির কাজ সুপারভাইজ করা, তারপর মাংস বিতরণে বের হওয়া আমার ওপরেই ন্যস্ত ছিল। সত্যি বলতে এ কাজ খুব একটা উপভোগ করিনি। এখানে অর্ডার দিয়ে কোরবানি দেওয়া যায়। তবে ঈদের দিনই মাংস পাওয়ার গ্যারান্টি নেই। অনেক মুসলমান শহর থেকে দূরে ফার্মে বা স্লটার হাউসে গিয়ে স্বহস্তে কোরবানি দেন। দেরিতে হলেও কোরবানির মাংস তারাই ঈদের দিন উপভোগ করে থাকেন। অন্যথায় কেনা মাংস দিয়েই ঈদ উদ্যাপন ও আপ্যায়ন সারা হয়। আমি তাই করে থাকি। আমার স্ত্রী দেশে ভাগে কোরবানি দেন। এ নিয়ে আমি তেমন মাথা ঘামাই না। কোথায়, কত ভাগ দেওয়া হলো, আমার জানার প্রয়োজন নেই। ঈদের উপহার কেনাকাটার জন্য সিডনিতে আগের দিন চাঁদ রাতের বাজার বসছে। ঈদের দিন বা তার কয়েক দিন পরে ঈদের মেলাও আর নতুন কিছু নয়। এবার আমাদের এলাকায় চার পাঁচটা ঈদের জামাত হলো। আমি বাড়ির কাছের ইঙ্গেলবার্ন কমিউনিটি সেন্টারের ঈদের জামাতে অংশগ্রহণ করি। এ জামাত বাংলাদেশি ও পাকিস্তানিরা যৌথভাবে কয়েক বছর ধরে আয়োজন করে আসছেন। আয়োজনে পাকিস্তানিদের প্রাধান্য চোখে পড়ে। একই পাকিস্তানি ইমাম এ পর্যন্ত ইমামতি করে আসছেন। বোধ হয় প্রাক ও নামাজ পরবর্তী বক্তব্য বা খুতবা একই রকম দিয়ে আসছেন ফি বছর। ইমাম এক সময় জানালেন, এখন বাংলাদেশি ভাইদের উদ্যোগে গরিব ও ভুখা বাংলাদেশিদের জন্য চাঁদা সংগ্রহ করা হবে। পরে বোধ হয় ব্যালান্স করার জন্য ভুখা পাকিস্তানিদের কথা বলা হলো। এক বাংলাদেশি ও পাকিস্তানি চাদর নিয়ে মুসল্লিদের মাঝে নেমে পড়লেন। আমি উঠে দাঁড়িয়ে বলতে চেয়েছিলাম, বাংলাদেশিরা এখন আর ভুখা থাকে না। কিন্তু চিরকাল ইমামেরা মসজিদে বক্তব্য দিয়ে আসছেন, আমরা শুনে এসেছি বা এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দিয়েছি। জামাতে ঠোঁটকাটা মুসল্লিদের বক্তব্য বা বাহাস অন্য মুসল্লিরা মেনে নেবেন না। চাঁদা সংগ্রহের জন্য নামাজ শুরু হতে দেরি হলো। এর মধ্যে এ জামাতের বাংলাদেশি উদ্যোক্তা স্মার্ট ফোনে ইমামসহ জামাতের কয়েক দফা ছবি নিলেন। জামাতের শেষে ইমাম মিলাদ শরিফ পড়ানো শুরু করলেন। অতীতেও করেছেন। আমার ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছিল, সকালে কিছু না খেয়েই বের হয়েছিলাম। ডায়াবেটিসের জন্য কিছু খাওয়া আবশ্যক হয়ে দাঁড়াল। তাই মিলাদ আর মোনাজাত বাদ দিয়ে বের হয়ে আসলাম। মুসল্লিদের জন্য মচমচে তাজা লালচে জিলাপি রাখা ছিল। এ জিলাপিটা খুবই উপভোগ করি। দুই পিস জিলাপি খাওয়ার পর দেহমন চাঙা হলো। তারপর হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরলাম। বাড়িতে পরিবারের সবাই আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। বউমার হাতে রান্না চমৎকার মুরগির রেজালা হোলমিল রুটি দিয়ে মজা করে খেলাম।
দুপুরে আমার ছোট ভায়রা শুভ ও ওর ছেলে সুমিত স্কুলের পরীক্ষা শেষে আমাদের এখানে ঘুরে গেল। বিকেলে এক ফাঁকে আমার শ্যালকের শ্যালক সাব্বিরের বাসা ঘুরে আসলাম। সাব্বির টেক্সট মেসেজ পাঠিয়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। তারপর টেলিফোন করে ফলোআপ করেছে। না গেলে অন্যায় হতো। এখানে ঈদের সময় বাড়ি বাড়ি যাওয়া অনেকটা প্রচলিত হয়ে গেছে। অনেকেই ঈদের দিনে নিজ নিজ বাড়ি ওপেন হাউস ঘোষণা দিয়ে আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবকে টেক্সট মেসেজ করে আমন্ত্রণ জানান। কেউ কেউ সকালে বের হয়ে প্রিয়জনদের সঙ্গে দেখা করে একবারে রাতে বাড়ি ফেরেন। এখন ঈদ বা অন্য পালা পার্বণে অতিথি আপ্যায়নের জন্য টেবিলে দশ-পনেরো পদের শাহি খাবার, ব্যঞ্জন ও মিষ্টান্ন উপস্থাপন করা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। প্রথম যখন অস্ট্রেলিয়া আসি ইফতারে পিঁয়াজি বেগুনি জুটবে কিনা সন্দেহ ছিল। কত পরিবর্তন! সন্ধ্যার পর অল্প সময়ের জন্য দুজন প্রিয় মানুষের বাসায় ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করতে গিয়েছিলাম। ওদের সঙ্গে সুন্দর কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে বাসায় ফিরলাম। আমার আর এক প্রিয় মানুষ ডেনটিস্ট শ্যালিকা শিখার সঙ্গে এবার দেখা হলো না, ও কাজে গেছে। আমাদেরও সীমাবদ্ধতা ছিল। আরও দুজন বন্ধু মানুষের বাসায় যাওয়ার ইচ্ছে ছিল, সময়ের অভাবের জন্য হলো না। এভাবেই এবার চাপাচাপির মধ্যেই কোরবানি ঈদের দিন কাটল। আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া আর একটি কোরবানি ঈদের দিন আমাদের উপহার দেওয়ার জন্য।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.