‘প্রথমে হালকা জ্বর। এরপরই শুরু হয় গায়ে ব্যথা, চুলকানি, শ্বাসকষ্ট, কাশি আর রক্তবমি। লক্ষণ দেইখ্যা মনে করছিলাম টিবি। ডাক্তার-কবিরাজের পথ্য খাওয়াইয়াও কোনো লাভ অয় নাই। অসুস্থ হইয়া একের পর এক দুনিয়া ছাইড়া চইলা গেছে আমার মা-বাবা, বড় ভাই, ভগ্নিপতি। তারা চারজনই রহিম স্টিল মিলের কেরোসিন সেকশনে কাজ করত। চাকরির চাইর বছরের মধ্যেই একে একে বিছনায় পইড়া যায় তারা।’
কথাগুলো বলছিলেন নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের বাঘরি দক্ষিণপাড়া গ্রামের সেকান্দার আলী। গত বছরের ১৮ জুন তার বাড়ির উঠানে বসে যুগান্তরের সঙ্গে কথা বলার সময় বাবা-মা, ভাই ও ভগ্নিপতির মৃত্যুর দিনক্ষণ লেখা একটি খাতাও দেখান। ওই খাতা আর হারানো চার স্বজনের ছবি বুকে চেপে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন সেকান্দার।
শুধু সেকান্দারের চার স্বজনই নয়, তাদের মতো রহিম স্টিল মিলস লিমিটেডের কেরোসিন সেকশনে কাজ করে একই ধরনের উপসর্গ নিয়ে অসুস্থ হয়েছেন অসংখ্য শ্রমিক। সোনারগাঁওয়ের একই গ্রামের ১২ জনসহ গত ১০ বছরে মারা গেছেন শতাধিক ব্যক্তি। এছাড়া এ মুহূর্তে অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন দুই শতাধিক শ্রমিক। এসব অভিযোগ মৃত শ্রমিকদের স্বজনের। তাদের অভিযোগ- অবৈধভাবে ওই মিলের কেরোসিন শাখায় তৈরি করা হয় প্রাণঘাতী কোয়ার্টস পাউডার। এই পাউডারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া প্রতিরোধে নেই কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা। যার কারণে সেখানে কাজ করার কয়েক মাসের মধ্যেই নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হন কর্মরত শ্রমিকরা।
ওই স্টিল মিলের কেরোসিন সেকশনে কাজ করে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন- এমন একাধিক শ্রমিকের আরও অভিযোগ, ‘উপর’ থেকে কোনো চাপ এলে কিছুদিনের জন্য বন্ধ রাখা হয় কোয়ার্টস পাউডার উৎপাদন। তখন ওই সেকশনে কোয়ার্টস পাউডার উৎপাদনের কাঁচামালসহ অন্য সামগ্রী সরিয়ে ফেলা হয়। সরকারের সংশ্লিষ্টদের ‘ম্যানেজ’ করে এখানে এক রকম নির্বিঘ্নে ১০ বছর ধরে অবৈধভাবে উৎপাদন করা হচ্ছে প্রাণঘাতী এই পাউডার। শুধু তাই নয়, কৌশলগত কারণে কেরোসিন সেকশনের শ্রমিকদের কোনো নিয়োগ বা পরিচয়পত্র দেয়া হয় না। কারণ ওই পাউডারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় কোনো শ্রমিক অসুস্থ অথবা মৃত্যুবরণ করলে তার দায় মিল মালিককে নিতে হবে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিয়োগ ও পরিচয়পত্র না পাওয়ার পরও শ্রমিকরা মিলটির কেরোসিন বিভাগে কাজ নিচ্ছেন। কারণ এই বিভাগে কাজ করলে অন্য শ্রমিকদের চেয়ে বেশি মজুরি দেয় মিল কর্তৃপক্ষ। এক্ষেত্রে নিরীহ ও দরিদ্র শ্রমিকরা খুব সহজেই তাদের প্রলোভনে পা বাড়ান। কিন্তু যখন শ্রমিকরা বুঝতে পারেন, তাদের শারীরিক অবস্থার ভয়াবহ অবনতি হয়েছে, তখন তাদের আর কিছু করার থাকে না। এমনকি অসুস্থ হওয়ার পর তাদের কাউকেই মিলের ভেতর প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। এমন পরিস্থিতিতে দিনের পর দিন অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকতে হয় শ্রমিকদের। তাদের অনেকেই ঢলে পড়েন মৃত্যুর কোলে।
যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধান ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে উল্লিখিত সব তথ্য। এ প্রসঙ্গে জানতে রহিম স্টিল মিলস লি. কর্তৃপক্ষের বক্তব্য নিতে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মো. মহসিনের সঙ্গে গত এক বছরে একাধিকবার তার দফতরে (রাজধানীর টিকাটুলি এলাকায়) সশরীরে উপস্থিত হন এই প্রতিবেদক। কিন্তু প্রতিবারই তার দফতর থেকে বলা হয়, তিনি অফিসে নেই অথবা বিদেশে আছেন। এছাড়া ইঞ্জিনিয়ার মহসিনের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন নম্বরে (০১৭১১৫৩০২২৯) অসংখ্যবার ডায়াল করা হয়। তবে কেউ রিসিভ করেননি। সর্বশেষ গত ২৮ আগস্ট মো. মহসিনের বক্তব্য পেতে তার ব্যক্তিগত ই-মেইলে (rahimsml@gmail.com) মেসেজ পাঠানো হয়। কিন্তু ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোনো জবাব আসেনি।
তবে বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগের পর ২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর টিকাটুলিতে রহিম স্টিল মিলস লিমিটেডের প্রধান কার্যালয়ে সাক্ষাৎ মেলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইস্রাফিলের। তিনি যুগান্তরকে বলেন, কেরোসিন সেকশনটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ওই সেকশনের শ্রমিকদের নিয়োগপত্র দেয়া হয় না এ অভিযোগ সঠিক নয়। শ্রমিকরা সব জেনেশুনে, বুঝেই এখানে কাজ করতে আসেন। যাদের কথা বলছেন, তারা যে এখানকারই শ্রমিক এর প্রমাণ কী?
কোয়ার্টস পাউডারের ভয়াবহতা বর্ণনা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োক্যামেস্ট্রি বিভাগের প্রফেসর ইকবাল আর্সলান বলেন, কোয়ার্টাস ডাস্ট শ্রমিকের দেহে প্রবেশ করলে ফুসফুসে (লাঙ) রক্ত জমে যায়। চোখে ড্রাইনেস হয়। চামড়ায় ডার্মাটাইটিজ, আর্থ্রাইটিজ হয়। যার পরিণাম মৃত্যু। তিনি বলেন, যেখানে কোয়ার্টাস পাউডার তৈরি হয় সেখানে যথাযথ বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা নিয়েই এটি করা উচিত। চিকিৎসার কোনো সুযোগ নেই। সাধারণ শ্রমিক হয়তো পেটের দায়ে এর ভয়াবহতা না জেনেই বিপজ্জনক এ কাজে নিয়োজিত হয়। যদি গোপনে এ ধরনের উৎপাদন হয়ে থাকে, তাহলে আইনশৃংখলা বাহিনীসহ প্রশাসনের হস্তক্ষেপ করা উচিত।
সরেজমিন দেখা গেছে, ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের দিকে যেতে কাঁচপুর ব্রিজ পার হলেই মহাসড়কের পূর্ব পাশে (নয়াবাড়ি) বিশাল এলাকাজুড়ে ‘রহিম স্টিল মিলস লি.’। মজবুত প্রাচীর না থাকলেও বিভিন্ন স্থাপনা বসিয়ে চাতুর্যের সঙ্গে নিশ্চিত করা হয়েছে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা। পুরনো লোহা-লক্কড় ও নির্মাণ সামগ্রী, বৃক্ষ-লতা, সিএনজি স্টেশন, দোকানপাট, ট্রাক স্ট্যান্ড বসানো রয়েছে মিলটির সম্মুখভাগে। পশ্চিমমুখী মূল প্রবেশদ্বারে রয়েছে কড়া নিরাপত্তা। প্রায় ৩শ’ বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত বিশাল এ কারখানার কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলি দূর থেকেই মানুষের দৃষ্টি কাড়ে। এ মিলটির ভেতরে রয়েছে কেরোসিন বিভাগ। যেটি মিল শ্রমিকদের কাছে ‘মৃত্যুকূপ’ হিসেবে পরিচিত।
মিলটির নিরাপত্তা ব্যবস্থা এতটাই কড়াকড়ি যে, মিল গেটের সামনে অথবা আশপাশ এলাকায় কেউ দাঁড়ালেই নিরাপত্তা রক্ষীদের জেরার মুখে পড়তে হয়। এমন নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যেও নানা কৌশল অবলম্বন করে গত বছরের ১৫ জুন দুপুরে ও ১৩ আগস্ট সকালে কারখানাটির ভেতর প্রবেশ করেন এই প্রতিবেদক। সেখানে কর্মরত শ্রমিকরা জানান, চুনাপাথর, বরিক পাউডার, পটাশিয়ামসহ কয়েক ধরনের কেমিক্যালের সংমিশ্রণে এখানে তৈরি হয় কোয়ার্টস পাউডার। শ্রমিকদের কেউ কেউ এটিকে বলেন ‘ক্রস পাউডার’।
শ্রমিকরা আরও জানান, কোয়ার্টস পাউডার ব্যবহৃত হয় রি-রোলিং মিল, সিরামিক ফ্যাক্টরি এবং পার্টিক্যাল বোর্ড তৈরিতে। আগে রহিম স্টিল মিলে এই পাউডার ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হতো। রি-রোলিং মিলের আড়ালে অতি গোপনে এটি এখন মিলের ভেতরই তৈরি করা হয়।
অন্ধকারে কর্তৃপক্ষ : রহিম স্টিল মিলের অভ্যন্তরে কোয়ার্টস উৎপাদনের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ৩০ আগস্ট পরিবেশ অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কাজী সারওয়ার ইমতিয়াজ হাশমী বলেন, ‘এ বিষয়ে কথা বলার যথোপযুক্ত ব্যক্তি ডিজি। কলকারখানায় জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিষয়গুলো দেখভালের ক্ষেত্রে আমাদের জনবল স্বল্পতা রয়েছে। রহিম স্টিল মিলের বিষয়ে কোনো ভুক্তভোগী কখনও অভিযোগ করেননি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে এ বিষয়ে অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা নেব।’
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের মহাপরিদর্শক সৈয়দ আহমেদ বলেন, ‘জানামতে এ রকম বিপজ্জনক কোনো কারখানার অনুমোদন সরকার দেয়নি। আমি দায়িত্ব নেয়ার আড়াই বছরের মধ্যে এমন কোনো তথ্যও আমাদের কাছে আসেনি। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বসহকারে দেখব। আমাদের প্রতিষ্ঠানের কেউ জড়িত থাকলে সে বিষয়েও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
সরেজমিন দেখা গেছে, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ থানাধীন সাদীপুর, কাঁচপুর, সনমান্দি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের ১২ জন রহিম স্টিল মিলের কেরোসিন সেকশনে কাজ করতেন। তারা সবাই একই ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। কেন কী কারণে তারা মারা যাচ্ছেন- সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারেন না কেউ। প্রথম মনে করা হয় জিন-ভূতের আছর। কিন্তু না। প্রথমে চুলকানি, চর্মরোগ, শ্বাসকষ্ট, কাশির সঙ্গে রক্তবমি, জ্বর, ব্যথা-শীর্ণকায় হয়ে যাওয়া- এমন অভিন্ন উপসর্গ নিয়েই মারা গেছেন তারা। কাঁচপুর ইউনিয়নের বাঘরি (দক্ষিণপাড়া) গ্রামের তোতা মিয়া (৬৫) মারা যান ২০০৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর। তোতা মিয়ার মেয়ের জামাই একই গ্রামের জাহের আলী (৪০) মারা যান ২০০৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর। পরের বছর ২ মার্চ মারা যান তোতা মিয়ার বড় ছেলে আবুল কাশেম (৩৫) । ২০১৪ সালের এপ্রিলে মারা যান তোতা মিয়ার স্ত্রী গুলবাহার (৬০)।
জাহের আলীর ছোট ভাই সরাফত আলী জানান, ভাই জাহের আলী আগে আদমজী জুট মিলের শ্রমিক ছিলেন। ছিলেন পরিশ্রমী, সুঠামদেহী। আদমজী বন্ধ হওয়ার পর রহিম স্টিল মিলের কেরোসিন বিভাগে কাজ নেন। এখানে ৪-৫ বছর কাজ করেন। একপর্যায়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে কাজ ছেড়ে দেন। প্রথম শ্বাসকষ্ট হয়। মনে করেছিলেন যক্ষ্মা-টিবিজাতীয় কিছু হয়েছে। ঢাকার বক্ষব্যাধি হাসপাতালে চিকিৎসা করানো হয়। লাভ হয়নি। এ বিষয়ে তিনি রহিম স্টিল মিল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও প্রতিষ্ঠানের প্রবেশদ্বার অতিক্রম করতে পারেননি।
কাঁচপুর ইউনিয়নের বাঘরি (দক্ষিণপাড়া) গ্রামের আবদুল গফুরের ছেলে নূরুজ্জামান (৪৮) মারা যান ২০১০ সালের ৭ ফেব্র“য়ারি। তার ছোট ভাই বদিউজ্জামান জানান, ৩-৪ বছর রহিম স্টিল মিলের কেরোসিন বিভাগে কাজ করেছেন নূরুজ্জামান। প্রথমে জ্বর, কাশি, কফের সঙ্গে রক্তবমি হতো তারও। সুঠামদেহী নূরুজ্জামান অল্পদিনেই শীর্ণকায় মানুষে পরিণত হন। দেশে চিকিৎসা শেষ করে চিকিৎসার জন্য ভারতে দু’বার নেয়া হয় তাকে। শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যায়নি।
একই ধরনের উপসর্গ নিয়ে আনোর আলীর ছেলে আজগর আলী (৩৫) মারা যান ২০১৪ সালের ২০ অক্টোবর। বাঘরি গ্রামের মকবুল আলীর ছেলে শামসুল হক (৫৫) মারা যান ২০০৯ সালের ২০ ফেব্র“য়ারি। রহিম স্টিল মিলে ৩ বছর কাজ করেছেন তিনি। অসুস্থ অবস্থায় এক বছর চিকিৎসায় নিঃস্ব হয়ে গেলে কাফনের কাপড়ের টাকাও জোটেনি তার। শামসুল হকের হাতে প্রথমে ঘা হয়। চর্মরোগের চিকিৎসা শেষ না হতেই শুরু হয় শ্বাসকষ্ট। কাশি, কফের সঙ্গে রক্ত। আলসারও ধরা পড়ে তার।
সাদীপুর ইউনিয়নের নগরটেঙ্গা গ্রামের ছায়েদ আলীর ছেলে হোসেন আলী (৪০) মারা যান ৩ বছর আগে। একই গ্রামের মৃত হাকিম আলীর ছেলে নূরুল ইসলাম (৫০) মারা যান গত বছর ১৪ জুন। ৮ বছর অসুস্থ থাকার পর তিনি মারা যান। ঘটিবাটি বিক্রি করে নিঃস্ব হয়ে যায় তার পরিবার। বাবার সঙ্গে কেরোসিন বিভাগে কাজ করে এখন অসুস্থ হয়ে পড়েছে ছেলে ওমর ফারুক। সে নিশ্চিত জানে, বাবার মতো তারও মৃত্যু হবে। কাশির সঙ্গে রক্ত-কফ আসে। ভারি কাজ করতে পারে না। অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটছে তার।
এ ছাড়া রহিম স্টিল মিলের কেরোসিন বিভাগে কাজ করা মৃত ব্যক্তিদের মিছিলে রয়েছেন বাঘরি গ্রামের লুৎফর মিয়া, হারেজ আলী, মজিবুর রহমান মজি, ইলিয়াছ মিয়া, আবেদন আলী (আবুদ) মিয়া, আবুদের ছেলে সিদ্দিকুর রহমান, পঞ্চমী ঘাটের নূরুল ইসলাম ওরফে নূরু মিয়া। সনমান্দি ইউনিয়ন, যাত্রাবাড়ী গ্রামের আক্কাস আলীর ছেলে দেলোয়ার হোসেন, নাজিরপুর গ্রামের মকবিল হোসেন, বাগবাড়ি গ্রামের হাফিজউদ্দিন এবং ছোনখালী গ্রামের হাসান আলী। এর বাইরে এসব ইউনিয়নে আরও শ’খানেক মৃত শ্রমিক রয়েছেন যারা রহিম স্টিল মিলের কেরোসিন বিভাগে কাজ করতেন।
মৃত্যুর প্রহর গুনছেন দুই শতাধিক : কেরোসিন বিভাগের নিঃশব্দ অপঘাত শরীরে ধারণ করে অসুস্থ হয়ে এখন চিকিৎসা নিচ্ছেন বাঘরি গ্রামের আবদুল আজিজের ছেলে মোস্তফা (২৮), আবদুল জলিলের ছেলে শহীদ মিয়া (৩২), শাহজাহান মিয়ার ছেলে মোক্তার হোসেন (৩৫), সাদীপুর ইউনিয়নের হাকিম আলীর ছেলে দিলু (৫০), মৃত নূরুল ইসলামের ছেলে ওমর ফারুক (২৭), চেঙ্গাকান্দি গ্রামের মৃত আবদুল মান্নানের ছেলে আবদুল মোতালেব (৩৫), কাজীপাড়া গ্রামের হাফিজুর রহমান (৫৫)।
মৃত্যু ঠেকাতে গামছা ও সাগরকলা : শ্রমিকরা জানান, রহিম স্টিল মিলের প্রতিষ্ঠাতা আবদুর রহিম কেরোসিন সেকশনটি চালু করেন নব্বই দশকে। স্টিল মিল, বোর্ড মিল ও সিরামিক ফ্যাক্টরিতে ব্যবহৃত কোয়ার্টস পাউডার একসময় আনা হতো ভারত থেকে। সেদেশের সরকার এটির উৎপাদন, নিয়ন্ত্রণ ও বন্ধ করে দিলে আবদুর রহিম দেশেই এটি উৎপাদনের উদ্যোগ নেন।
২০০৩ সালে কঠোর গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে ফ্যাক্টরির ভেতরেই পরীক্ষামূলকভাবে উৎপাদন শুরু করেন। ওই সময় কেরোসিন সেকশনে কাজ করে আক্রান্ত শ্রমিক আব্বাস উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, রহিম সাহেব এ সেকশনে শ্রমিকদের নানা ধরনের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলতেন। মুখে গামছা বেঁধে নেয়ার কথা বলতেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, এখানে কাজ করাটা ঝুঁকিপূর্ণ। তোমরা জান না গামছা না বাঁধলে কি হয়। আবদুর রহিমের সতর্কতা তার ছেলে মহসিন কখনও উচ্চারণ করেন না। কৌশল হিসেবে তিনি এখন শ্রমিক আনেন দারিদ্র্যপীড়িত রংপুর, গাইবান্ধা, নীলফামারী, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, বরিশাল, মাদারীপুর চরাঞ্চল ও শরীয়তপুর থেকে।
কেরোসিন সেকশনের সাবেক সুপারভাইজার আবদুল বারেক জানান, কেরোসিন সেকশনে শ্রমিক নেয়া হয় স্থানীয় কন্ট্রাকটরদের মাধ্যমে। তারা অতিরিক্ত পয়সার লোভ দেখিয়ে বেকার, দরিদ্র ও অশিক্ষিত শ্রমিকদের এ সেকশনে এনে কাজ দেয়। এখানে অল্প পরিশ্রমে অধিক পয়সা দেয়া হয়। অন্যান্য সেকশনে যেখানে ৮ ঘণ্টা ডিউটি, সেখানে কেরোসিন সেকশনে মাত্র ৬ ঘণ্টা ডিউটি করে টাকা দেয়া হয় ১৬ ঘণ্টার। এ হারে মাসে ৬ থেকে ৮ হাজার টাকা রোজগার করেন একেকজন শ্রমিক। মূলত অল্প পরিশ্রমে অধিক মজুরির টোপ দিয়ে শ্রমিক নেয়া হয়। এ কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের কোনো নিয়োগপত্র দেয়া হয় না। দেয়া হয় না কোনো পরিচয়পত্রও। টোকেনের মাধ্যমে প্রতি সপ্তায়, কখনও বা দিনেরটা দিনেই নগদ পরিশোধ করা হয় মজুরি। এ কারণে কোনো শ্রমিক নিজেকে রহিম স্টিলে মিলের শ্রমিক দাবি করতে পারেন না। প্রতারিত হলে নিতে পারেন না কোনো আইনগত সহায়তা। বাঘরি গ্রামের জাকির হোসেন কেরোসিন সেকশনে ৫০ জনেরও বেশি শ্রমিককে কাজ দিয়েছে। যাদের অধিকাংশই মারা গেছেন।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.