ছয় কুড়ি বিল আর নয় কুড়ি কান্দা। আকাশ-পাহাড় আর জলের মাখামাখি। জল-জোছনার খেল। ঢেউ আর হৃদয় আন্দোলিত করা খোলা হাওয়া। বাংলাদেশের অন্যতম রূপ-বৈচিত্র্যের হাতছানি বিশ্ব ঐতিহ্যের রামসার সাইট টাঙ্গুয়ার হাওর।
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার এ হাওরে বিশাল নৌবহর সহযোগে গতকাল শুক্রবার রাতে শুরু হয়ে এই ‘জ্যোৎস্না উৎসব’ শেষ হচ্ছে আজ শনিবার ভোরে। তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ এ উৎসবের আয়োজক। শুক্রবার সকালে তাহিরপুর উপজেলা সদরের পাটলাই নদী থেকে রওনা দেয় জ্যোৎস্না উৎসবের নৌবহর। নৌকায় আছে নানা অনুষ্ঠান পর্ব। দিনভর বৈচিত্র্যময় হাওরের সুন্দর স্পটগুলোর সঙ্গে পরিচিত হন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা ভ্রমণার্থীরা। এ ছাড়া হাওররাজ্যের জমিদার বাড়িগুলোও দেখতে পারবেন পর্যটকরা।
নৌকায় থেকেই ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের সঙ্গে মেঘের মিশে যাওয়ার সৌন্দর্য, টাঙ্গুয়ার হাওর পারের পাহাড়ঘেঁষা টেকেরঘাট খনিজ প্রকল্পও দেখা যায়। মেঘালয় পাহাড়ের নিচে অবস্থিত খনিজ প্রকল্পের ‘নিলাদ্রী’খ্যাত নীল রঙের জলের লেক ও জলের মাঝে হিজল-করচের বাগানের সৌন্দর্য দেখবেন পর্যটকরা। শীতে আসা অতিথি পাখিদের কয়েক প্রজাতির দেখা মিলবে। থাকছে ভাটির লোকগানের আসর।
প্রথম রাতে হাওরের মাঝখানে ভাসমান মঞ্চে থাকবে লোকগান ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক আয়োজন। আর এর মিশেলে জোছনাসুধায় মাতবেন দূর-দূরান্তের পর্যটকরা। বিরল এ জ্যোৎনা উৎসব উপভোগ করতে ইতোমধ্যে সুনামগঞ্জ শহরে ভিড় জমিয়েছেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ। আয়োজনে অংশ নিয়ে সবাইকে আনন্দ দিতে স্থানীয় ও জাতীয় শিল্পীরাও প্রস্তুত। উৎসবের প্রথম দিন অর্থাৎ গতকাল শুক্রবার মধ্যরাতে হাওরের বুকে হিমেল হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মরমি সুরের মুগ্ধতায় তারা সবাইকে মাতিয়ে তোলেন।
এদিকে এ উৎসবে অংশ নিতে ইচ্ছুকরা গত বুধবারের মধ্যেই সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় জনপ্রতি ২৫০০ টাকায় বুকিং নিশ্চিত করেছেন। দ্বিতীয় দিন তাহিরপুর উপজেলার রূপের নদী যাদুকাটাও ঘুরে দেখানোর ব্যবস্থা আছে। এ নদীটি সীমান্তবর্তী হওয়ায় বছরের প্রতিদিনই পর্যটকরা এখানে ঘুরে বেড়ান। উপভোগ করেন পাহাড়ি এ নদীর মনোমুগ্ধকর সব দৃশ্য।
নদীর তীরঘেঁষে রয়েছে বারেকের টিলা। রাতে এই টিলায় হবে উপজাতিদের অংশগ্রহণে অন্য রকম ভালো লাগার এক উৎসব। দেশের বৃহত্তম বারণি উৎসবের স্থান ও অদ্বৈতধামও পরিদর্শনের সুযোগ থাকছে এ আয়োজনে অংশ নেওয়া পর্যটকদের। পীর শাহ আরেফিনের মাজারও দেখা যাবে। সব মিলিয়ে বর্ণাঢ্য আয়োজন সাজিয়েছেন উৎসবের আয়োজকরা। তাদের মতে, এ উৎসবের মধ্য দিয়ে দেশবাসীর কাছে সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরের সৌন্দর্য ও এ অঞ্চলের পর্যটন সম্ভাবনা তুলে ধরা হবে। এ ছাড়া এ হাওরকে কেন্দ্র করে পর্যটন অবকাঠামো গড়ে তোলার জন্য দাবি ও সুপারিশমালাও তৈরি করবেন আয়োজকরা।
জ্যোৎস্না উৎসবের আয়োজক তাহিরপুর উপজেলা চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, ‘টাঙ্গুয়ার হাওরের জ্যোৎস্না উৎসবে অংশ নিতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ তাদের বুকিং নিশ্চিত করেছেন। মুঠোফোনে অনেকেই এ আয়োজনকে স্বাগত জানিয়েছেন। গতকাল শুক্রবার দুপুর আড়াইটায় তাহিরপুর থেকে টাঙ্গুয়ার হাওরের উদ্দেশে এ নৌ ভ্রমণ শুরু হয়। বিকাল ৫টার দিকে দুই দিনের এ নৌ ভ্রমণ ও জ্যোৎস্না উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন স্থানীয় সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন। এ সময় সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য শাহানা রব্বানী, জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলামসহ জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। দুই দিনব্যাপী নৌ ও জ্যোৎস্না উৎসবের পাশাপাশি টাঙ্গুয়ার হাওরের ভেতরে নির্মিত ভাসমান নৌকা মঞ্চে রাতভর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এদিকে এ উৎসবকে কেন্দ্র করে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে স্থানীয় প্রশাসন। এজন্য হাওরের আশপাশের এলাকায় দুই শতাধিক পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। এ ছাড়া বিজিবির বিশেষ টহল থাকবে বলে জানিয়েছেন উৎসবের আয়োজক তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান। আয়োজক সূত্র জানায়, শুক্রবার টাঙ্গুয়ার হাওরে নৌ ভ্রমণে রাত কাটিয়ে আজ যাদুকাটা ও বড়গোপ টিলায় রাতযাপন করবেন অংশগ্রহণকারীরা। রাতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন স্থানীয় টিলায় বসবাসকারী আদিবাসী জনগোষ্ঠীর শিল্পীরা। এ বিষয়ে তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান জানান, দুই দিনের নৌ ভ্রমণ ও জ্যোৎস্না উৎসবে ব্যাপক সাড়া পড়েছে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.