পিতা মাওলা বখশ সরদার ছিলেন ঢাকার শেষ সরদার। ফরাশগঞ্জ এলাকা ছিল সরদারের আবাস। বুড়িগঙ্গার পাড় ঘেঁষে এই এলাকাটিই ছিল ঢাকার প্রাণকেন্দ্র। কি ছিল না এই এলাকাতে। আন্টাঘর যা পরে ভিক্টোরিয়া পার্ক, আহসান মঞ্জিল, নর্থব্রুক হল, বাকল্যান্ড বাঁধ, দেবনিবাস, লেডিস পার্ক, করোনেশন পার্ক, ব্রাহ্ম মন্দির, কলেজিয়েট, পগোজ আর জগন্নাথের মতো খ্যাতনামা সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। দিন শেষে রাতের আঁধারে আলোর রোশনাই ছিল এ এলাকাতেই। শেষ সরদার গত হয়েছেন তাও অনেকদিন। কিন্তু সেই ঢাকার কি হাল? ঢাকা কি থমকে আছে? নতুন উদ্যম আর প্রাণশক্তি নিয়ে মাওলা বখশের সুযোগ্য সন্তান আজিম বখশ গড়ে তুলেছেন ঢাকা কেন্দ্র। যে প্রতিষ্ঠান ঢাকাকে চিরকালের করতে কাজ করে যাচ্ছে অক্লান্ত। আজিম বখশের মুখোমুখি হয়েছিলাম কেমন ছিল ষাটের দশকের ঢাকা। চার দশকের ঢাকার বদলে যাওয়ার চিত্রটাই বা কেমন? তার জবানীতেই জানা যাক এক সমৃদ্ধতর ঢাকার গল্পগাথা- সময়টা ১৯৬০ সাল। গুলশান তখন প্রায় তৈরি হয়ে গেছে। আমরা তখন পুরনো ঢাকা থেকে দল বেঁধে পিকনিক করতে আসতাম। বর্তমানে আমি গুলশানের বাসিন্দা। গুলশান-১ এলাকার ২নং সাউথ এভিনিউতে আমি বাস করি। কর্মস্থল যদিও ফরাশগঞ্জে। যে সময়ের কথা বলছি তখন গুলশান অভিজাত এলাকার মর্যাদা পায়নি। তখন বর্তমানে যেখানে শুটিং ক্লাব তা ছিল একটি পার্ক। তা ছিল লেডিস পার্ক বলে পরিচিত। আর বর্তমানের সাউথ পার্কটি তাও ছিল। রাস্তার দু’পাশে দু’টি পার্কের একটি বর্তমানে টিকে আছে। আর লেডিস পার্ক বলে পরিচিতি স্থানটিতেই শুটিং ক্লাবসহ বেশকিছু স্থাপনা বর্তমানে তৈরি হয়েছে। লেডিস পার্কের অস্তিত্ব অনেক আগেই বিলুপ্ত। গুলশান দুই নম্বরে ওয়ান্ডারল্যান্ডটিও একসময় পার্ক ছিল। পরে সেখানে পার্কের স্থলে বাণিজ্যিকভাবে ওয়ান্ডারল্যান্ড হয়। দীর্ঘদিন পরে তা আদালতের রায়ে উচ্ছেদ করে সেখানে সিটি করপোরেশন আবারও পুরনো অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। গুলশান দুই নম্বর এলাকাতেই আরেকটি পার্ক আছে যেখানে এক সময় বাংলা চলচ্চিত্রের শুটিং হতো। সেই পার্কটি সকলের কাছে লেক পার্ক বলে পরিচিত। এ এলাকার মাঝামাঝিতে আরও একটি পার্ক আছে যা লেডিস পার্ক বলে সূচিত হলেও বর্তমানে ট্যাঙ্কপার্ক বলে পরিচিত। একসময় ট্যাঙ্কপার্ক এলাকায় অদ্ভুত সুন্দর দেখতে একটি বাড়ি ছিল। দেখতে অনেকটা বজরা নৌকোর মতো। সম্ভবত এটি গুলিস্তান সিনেমা হলের মালিক দোসানির পরিবারের। গুলশান এলাকায় সরকারি উদ্যোগে দু’টি মার্কেটের নির্মাণ কাজ ১৯৬০ সালের দিকেই শুরু হয়েছিল। সে সময় গুলশান-১ নম্বর গুদারাঘাট বলে এলাকাবাসী জানতো। এখানে একটি কাঠের জেটি ছিল। জেটি এলাকায় বিকালে অনেকেই পরিবার-পরিজন নিয়ে বেড়াতে আসতেন। বিরান জায়গা হলেও নিরাপত্তার কোনো ঘাটতি ছিল না। গুলশান-১ এ আমাদের বাড়ির উল্টোদিকে খ্যাতনামা পরিচালক প্রয়াত এহতেশামের ভাই মুস্তাফিজ সাহেব থাকতেন। তিনি নিজেও চলচ্চিত্র পরিচালনায় যুক্ত ছিলেন। এ বাড়িতেই বিয়ে হয়েছিল এহ্তেশামের কন্যার সঙ্গে পাকিস্তানের উঠতি নায়ক নাদিমের। সে সময় ঢাকার আলোচিত ঘটনা ছিল এই বিয়ে। সেই বিয়েতে লেকের পাড়ে বাঁশ গেড়ে গোল গোল করে আলোকসজ্জার মাধ্যমে আলপনা করা হয়েছিল। তা দেখার জন্য লেকের দু’পাড়ের লোকজন সন্ধ্যায় ভিড় করতো। সে সময় এতোটা হইচই আর ঝলমলে বিয়ে আর হয়নি। লেকপাড়ে বাসিন্ধারা দীর্ঘদিন সেই বিয়ের অনুষ্ঠান স্মরণে রেখেছে। ষাটের দশকে বিদেশিরা ব্যাপকহারে গুলশান এলাকায় একতলা বাড়িগুলোতে ভাড়া থাকতেন। আমাদের বাড়িতেও বিদেশিরা থেকেছেন অনেকদিন।
গুলশানে বসতি স্থাপন করলেও পুরনো ঢাকার ফরাশগঞ্জের কর্মস্থলে প্রতিদিনই যেতে হয়। গুলশানের সাউথ এভিনিউতে আমাদের বাড়ির কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৬৯ সনে। তখন নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থেকে ইটের নৌকা ধোলাইখাল বালু নদী হয়ে গুলশানে আমাদের বাড়িতে পৌঁছে দিতো। সে সময় নৌকাপ্রতি দাম পড়তো ১ হাজার ইট পৌঁছানোসহ ১০০ টাকা। বর্তমান ঢাকার অনেক পরিবর্তন। আগের সময়কে বর্তমানের সঙ্গে কোনোভাবেই মিলাতে পারি না। আবারও পিছনে ফিরি। আমি তখন ক্লাস সিক্সে সেন্ট গ্রেগরির ছাত্র। আমাদের স্কুলের পিকনিক হয়েছিল বর্তমান মোহাম্মদপুর এলাকার সাতমসজিদ এলাকায়। দলবেঁধে সবাই বাসে করে সাত মসজিদে পিকনিক করতে গেলাম। তবে বাস বর্তমানের মতো সাতমসজিদ এলাকায় যেতে পারেনি। আমরা মোহাম্মদপুর এলাকায় টাউন হল বাজার পর্যন্ত যেতে পেরেছিলাম। পরে সেখানে নেমে নৌকায় করে সাত মসজিদে পৌঁছেছি। মসজিদের চারদিকে থই থই পানি। আমাদের গাইড ছিলেন রহমতউল্লাহ স্যার। তিনি গত হয়েছেন তাও অনেকদিন। মসজিদের চারদিকে পানি বেশি থাকায় স্যারের বকুনি খেয়ে সবাইকে নড়াচড়া বন্ধ করেই নৌকায় বসে থাকতে হয়েছিল। আজ কোথায় তা মিলিয়েছে। এখন মসজিদতো দূরের কথা মসজিদের পেছনে যে পরিমাণ বসতি স্থাপিত হয়েছে তা পায়ে হেঁটে পাড়ি দেয়াও কষ্টকর অনেকের জন্য। নদীর দেখাতো সুদূরপরাহত। ১৯৬৩-৬৪ সালের কথা বলছি, ফুলবাড়ীয়া বা গুলিস্তান থেকে গুলশান আসার পথ ছিল অনেকটাই প্যাঁচানো। বর্তমানে যে তেজগাঁও লিংক রোড বা কাকরাইল থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত সোজা রোড তা ছিল না। বর্তমানের গুলশান ছিল তেজগাঁও থানার অন্তর্ভুক্ত। সদরঘাট থেকে গুলশান কোনো সরাসরি পরিবহন ছিল না। কাওরানবাজার দিয়ে যেতে হতো। কাওরানবাজার রেললাইন হয়ে নাবিস্কো। তারপর মহাখালী। এভাবেই ধাপে ধাপে গুলশান পৌঁছাতে হতো। সে সময় বাংলামোটর থেকে ময়মনসিংহের সরাসরি কোনো রাস্তা ছিল না। তেজগাঁওর সরকারি রাস্তাটি রানী এলিজাবেথের ঢাকায় আসা উপলক্ষে তৈরি হয়েছিল। তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তানের গভর্নর আজম খান রাস্তা নির্মাণের সময় অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন। তিনি সে সময় শ্রমিকদের সঙ্গে বসে মাটির থালায় ভাতও খেয়েছিলেন বলে সকলের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিলেন। তখনকার পত্র-পত্রিকায় এ নিয়ে নানা লেখালেখি হয়েছিল। ঊইউ-৩২ নামে আমাদের একটি গাড়ি ছিল। সে সময় গাড়ি এয়ারপোর্টে রেখে তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে বিমানে চট্টগ্রামে চলে যেতাম। দু’দিন বেড়ানো শেষে চট্টগ্রাম থেকে যখন ঢাকায় ফিরতাম দেখতাম বিমানবন্দরে গাড়ি যেভাবে রেখে গিয়েছিলাম ঠিক সেভাবেই পড়ে আছে। নাগরিকদের মধ্যে সে সময় কোনোরকম নিরাপত্তার ঘাটতি ছিল না। ১৯৬৬-৬৭ সালের দিকে ঢাকায় প্রথম টয়োটা গাড়ি আসে। নতুন ঢাকায় ধীরে ধীরে অবকাঠামো ও স্থাপনা নির্মিত হচ্ছে। সে সময় নতুন ঢাকার অনেকেই গুলিস্তান ভবন এলাকায় টয়োটা গাড়ি রেখে রিকশা করে পুরনো ঢাকায় যেতেন। গুলিস্তান ভবনের নিচে রমনা ফার্মেসি নামে একটি ওষুধের দোকান ছিল আমাদের বন্ধু জাহাঙ্গীরদের। উল্টোদিকে ছিল বেবী আইসক্রিম নামে উন্নতমানের একটি দোকান। তার সঙ্গে ওষুধের আরেকটি দোকান ছিল ভাম অ্যান্ড কোম্পানি। ওখানে মিকশ্চার ওষুধ তৈরি হতো। এটি ছিল অবাঙালিদের দোকান। সেখানে দু’টি বৃহৎ কাঁচের জার থাকতো। যার একটিতে লাল অন্যটিতে নীল রঙের পানি থাকতো। নগরীর লোকজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই রঙিন পানির খেলা দেখতো। হয়তো সৌন্দর্য বর্ধনের জন্যই জারে রঙিন পানি রাখা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে কয়েকটি বিখ্যাত রেস্টুরেন্ট ছিল। লা-সানি রেস্টুরেন্ট, রেক্স রেস্টুরেন্ট এবং গুলিস্তান ভবনে চু-চিন-চৌ। চু-চিন-চৌ ছিল প্রথম ঢাকার চাইনিজ রেস্তরাঁ। গুলিস্তান সিনেমা হলের এখানেই ছিল গুলিস্তান রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড বার। যার মালিক ছিলেন পূর্ণিমা সেনগুপ্ত। হলের পাশেই ছিল চলচ্চিত্র পরিচালক এহ্তেশাম ও মুস্তাফিজের মালিকানায় সুইট হেভেন। গুলিস্তানের পরই আসে ফুলবাড়ীয়া। ফুলবাড়ীয়া রেলগেট নতুন-পুরনো ঢাকার সীমানা নির্ধারণ করতো। পরবর্তীতে নবাবপুরে আরও বেশ কিছু রেস্তরাঁ চালু হয়েছিল। এরমধ্যে একটি ছিল ক্যাপিটাল রেস্তরাঁ। এর মালিক ছিলেন ফরাশগঞ্জের এস কে দাস অ্যান্ড ব্রাদার্স। তাদের মোগলাই পরোটা ছিল অতুলনীয়। তারপরে ছিল আমিনীয়া-আমজাদিয়া। এই রেস্টুরেন্টগুলো ছিল দিল্লি ঘরানার। রথখোলার কাছাকাছি মালিটোলার গলির মুখে খোশমহল নামে একটি রেস্টুরেন্ট ছিল। খোশমহলের খোশকা পোলাও ছিল খুবই বিখ্যাত। মূলত সাদা পোলাওকেই খোশকা পোলাও নামে সকলে চিনতো। তারপর সেন্ট্রাল রেস্টুরেন্ট। সেন্ট্রাল রেস্টুরেন্টের মূলত কাবুলিওয়ালাদের আড্ডা ছিল। রায় সাহেব বাজারে (রাইসা বাজার নামেই পরিচিত) ছিল ইসলামিয়া রেস্টুরেন্ট। কোর্টের উল্টো দিকে ছিল ঢাকার প্রথম ইংলিশ রেস্টুরেন্ট ‘ওকে’। যা বৃটিশ আমলে চালু হয়েছিল। পাকিস্তান আমলে তার নাম বদলে হয় মাইরেন্ডার। যা চালাতো অ্যাংলো ইন্ডিয়ান লেডি মিসেস ডলি। অভিজাত রেস্টুরেন্ট ছিল মাইরেন্ডার। এটি ছিল বারও। যারা খাবার পরিবেশন করতেন তাদের মাথায় পাগড়ি, পরনে শেরোয়ানি ও কোমরে লাল বেল্ট থাকতো। অনেকটা আর্দালির মতো। সেখানেই আমি প্রথম ফ্রিজ দেখেছিলাম।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.