লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়েছে ইলিশের বাণিজ্য। চলতি বছরে ৪ লাখ টন ইলিশ আহরণের কর্মসূচি পালন করেছিল সরকার। ইতিমধ্যে ছাড়িয়ে গেছে। মৎস্য অধিদফতর ধারণা করছে, বছর শেষে তা সাড়ে ৪ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে। সংস্থাটির মতে, ইলিশ উৎপাদনে গত ১৮ বছরের মধ্যে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। এর আগে ১৯৯৮ সালে দেশে প্রচুর পরিমাণে ইলিশ ধরা পড়েছিল। ফলে বিশ্লেষকদের ধারণা চলতি বছরে ইলিশের বাণিজ্য ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। উৎপাদন বেশি হওয়ায় দামও নাগালের মধ্যে।
ফলে সাধারণ মানুষও কিনতে পারছে। একই সঙ্গে বিশ্বে দেশের ইলিশের নতুন বাজার তৈরির সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছে। এদিকে ইলিশের কারণে বাজারে অন্যান্য মাছের দামও কম।
জানতে চাইলে মৎস্য অধিদফতরের মহাপরিচালক সৈয়দ আরিফ আজাদ যুগান্তরকে বলেন, সরকারের পরিকল্পিত কর্মসূচির কারণেই ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে। বছর শেষে তা লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে।
তিনি বলেন, এ বছর ১২ থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করেছে সরকার। এ সময়ে আমাদের কর্মকর্তারা এবং আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালাবে। আর এ কর্মসূচি সঠিকভাবে পালন হলে আগামী বছর ইলিশের উৎপাদন আরও বাড়বে।
সূত্র জানায়, ইলিশ পাওয়া যায় বিশ্বের এমন ১১টি দেশের মধ্যে ১০টিতেই উৎপাদন কমছে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রতিবছর উৎপাদন প্রায় ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে বিশ্বে প্রতিবছর ৫ লাখ মেট্রিক টন ইলিশ আহরিত হয়।
এর ৬০ শতাংশই বাংলাদেশে। অন্যদিকে দেশে মোট মৎস্য উৎপাদনে এককভাবে ইলিশের অবদানই প্রায় ১৫ শতাংশ। আর মোট দেশজ উৎপাদনেও (জিডিপি) এ খাতের অবদান ১ দশমিক ১৫ শতাংশ। সূত্র আরও জানায়, গত কয়েক বছর ধরেই দেশে ইলিশের উৎপাদন ৩ থেকে ৪ লাখ মেট্রিক টনের মধ্যে উঠানামা করছে।
এর মধ্যে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ছিল ৩ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টনে। তবে ইলিশের গড় উৎপাদন হচ্ছে সাড়ে ৩ লাখ মেট্রিক টনের মতো। কিন্তু বছরে তা সাড়ে ৪ লাখ মেট্রিক টনে পৌঁছাবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রচলিত বাজার মূল্যে প্রতিকেজির দাম কম করে ৬৫০ টাকা ধরা হলেও সংগৃহীত সাড়ে ৪ লাখ টন ইলিশের সার্বিক বাজার মূল্য দাঁড়ায় ৩০ হাজার কোটি টাকা।
ভোলা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা রেজাউল করিম জানান, গত ১৭ দিনে শুধু ভোলা জেলায় ইলিশের উৎপাদন ১ লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়েছে। ফলে এবার ১০ বছর পর লাভের মুখ দেখছেন বিনিয়োগকারীরা। এ ভরা মৌসুমে ইলিশ ধরে পানির দামেই বিক্রি করছেন জেলেরা।
জানতে চাইলে চাঁদপুরের মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের গবেষক ড. আনিসুর রহমান বলেন, স্বাভাবিকভাবেই ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে। মূলত জাটকা নিধন ও মা ইলিশ ধরা বন্ধ এবং মাছের অভয়ারণ্য বাস্তবায়নের কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে।
তিনি বলেন, মা ইলিশ ও ডিম বাড়ছে, মাছও বাড়ছে। তিনি আরও বলেন, ২০০৯ সালে সাগর-নদী উপকূলীয় এলাকা চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, ভোলা ও পটুয়াখালীর ২১ উপজেলায় জাটকা নিধন বন্ধ, মা ইলিশ রক্ষা ও ইলিশের বংশবিস্তারের জন্য ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়। পরবর্তী সময়ে এ কর্মসূচি ছড়িয়ে দেয়া হয় দেশের ২৫ জেলায়। তার সুফল এখন পাওয়া যাচ্ছে।
জানা গেছে, বর্তমানে সারা দেশে প্রচুর ইলিশ মিলছে। আর দামও সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে। তবে সরবরাহ বেশি হওয়ায় ঢাকায় তুলনামূলকভাবে দাম আরও কম। বড় আকারের প্রতি হালি ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১২০০ থেকে দেড় হাজার টাকায়। এ ছাড়া মাঝারি আকারের হালি প্রতি ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকার মধ্যে। ছোট ইলিশ বা ঝাটকা বিক্রি হচ্ছে হালি প্রতি ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায়।
মৎস্য অধিদফতর জানিয়েছে, দেশে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ইলিশের অবদান ১ দশমিক ১৫ শতাংশ। দেশের মোট মাছের প্রায় ১৫ শতাংশের উৎপাদন আসে ইলিশ থেকে। ইলিশ রফতানি করে ৪০০ কোটি টাকার মতো বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়। এ ছাড়া প্রায় ৫ লাখ লোক ইলিশ আহরণে সরাসরি জড়িত। পরোক্ষভাবে ২০-২৫ লাখ লোক পরিবহন, বিক্রয়, জাল ও নৌকা তৈরি, বরফ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রফতানি ইত্যাদি কাজে জড়িত।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান ও মৎস্যবিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক সাইদুর রহমান চৌধুরী বলেন, ইলিশ নিয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন। মাছ সংরক্ষণ করা যাবে না। নদীগুলো ইলিশ উপযোগী কি না বা মাছ সংরক্ষণ মৌসুম কতদিন রাখতে হবে, সেটি জানতে গবেষণা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, সরকার যে অভয়াশ্রমের কথা বলছে, সেটিও কতদিন রাখা যাবে তাও অনিশ্চিত। এই বিশেষজ্ঞ বলেন, সরকার যে কয়দিন মাছ ধরা বন্ধ করছে, সে সময়েই ইলিশ সর্বোচ্চ ডিম দেয় কি না, তা জানা নেই। তাই কখন ইলিশ প্রচুর ঢুকছে সেটি জেনে কর্মসূচি নিতে হবে। পানি প্রস্তুত কি না- সেটিও খেয়াল রাখতে হবে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.