শিমন পেরেজ মারা গেছেন। শোনার সঙ্গে সঙ্গে দুনিয়া চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো ‘শান্তিস্থাপক’ (পিসমেকার)! কিন্তু আমি যখন শুনলাম পেরেজ মারা গেছেন, আমার চোখের সামনে ভেসে এলো রক্ত, আগুন আর হত্যাযজ্ঞের চিত্র। আমি ফলাফলটা নিজের চোখেই দেখেছি। ক্ষতবিক্ষত শিশু, তীব্রস্বরে চিৎকাররত শরণার্থী আর লাশের স্তূপ। জায়গাটার নাম ক্বানা। এখন জাতিসংঘ শরণার্থী শিবিরের নিচে ঘুমিয়ে আছে সেই ১০৬টি মরদেহ, যাদের অর্ধেক ছিল শিশু। ১৯৯৬ সালে ইসরাইলি কামানের গোলায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল তাদের শরীর। দক্ষিণ লেবাননে অবস্থিত গ্রামটির ঠিক বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা জাতিসংঘের ত্রাণবহরে ছিলাম আমি। ঠিক আমাদের মাথার ওপর দিয়ে গোলাগুলো গিয়ে পড়েছিল শরণার্থীদের ওপর। ১৭ মিনিট ধরে চলেছিল গোলাবর্ষণ। তখন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী শিমন পেরেজ। তিনি আবার ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীও। তার উত্তরসূরি ইতজাক রবিনকে চরমপন্থি ইসরাইলিরা হত্যার পর তিনি প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসেন। আসন্ন নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতা পোক্ত করতে গিয়ে তিনি ভাবলেন নিজের সামরিক অর্জন বাড়ানো দরকার। নির্বাচনের ঠিক আগে আগে হামলা চালালেন লেবাননে। যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী পেরেজ লেবানন সীমান্তের ওপার থেকে হিজবুল্লাহর রকেট নিক্ষেপকে যুদ্ধ চালানোর অজুহাত বানালেন। প্রকৃতপক্ষে, ওই রকেট নিক্ষেপ করা হয়েছিল ইসরাইলি সেনাদের ফেলে যাওয়া বুবি ট্রাপে পড়ে এক ছোট লেবানিজ শিশুর মৃত্যুর প্রতিশোধ হিসেবে। শিশুটির মৃত্যুর কোনো দাম ছিল না। কয়েকদিন পর লেবাননের ভেতরে অবস্থানরত ইসরাইলি সেনারা ক্বানা গ্রামের পাশে আক্রমণের শিকার হয়। প্রতিশোধ হিসেবে গ্রামের ভেতরই গুলি করতে থাকে তারা। তাদের প্রথম গোলা আঘাত করে হিজবুল্লাহর ব্যবহৃত একটি কবরস্থানে। বাকিগুলো সরাসরি জাতিসংঘের ফিজিয়ান সেনা শিবিরে আঘাত হানে। অথচ, সেখানে আশ্রিত ছিল শ’ শ’ বেসামরিক মানুষ। হামলার পর পেরেজ ঘোষণা দিলেন, ‘আমরা জানতাম না যে, কয়েক শ’ মানুষকে ওই শিবিরে জড়ো করা হয়েছিল। এটা আমাদের কাছে তিক্ত বিস্ময় হিসেবে দেখা দিয়েছে।’ এটা ছিল একটা ডাহা মিথ্যা কথা। ১৯৮২ সালে লেবাননে আক্রমণের পর থেকে ক্বানা গ্রামটি কয়েক বছর ইসরাইলিদের দখলে ছিল। ওখানকার জাতিসংঘ শিবিরের ভিডিও ফুটেজও তাদের কাছে ছিল। ১৯৯৬ সালের ওই হত্যাযজ্ঞের সময় তারা শিবিরের ওপর দিয়ে ড্রোন চালিয়েছে। এ বক্তব্যটি তারা অনেকদিন ধরে অস্বীকার করেছিল। পরে জাতিসংঘের এক সেনা আমাকে ওই ড্রোনের ভিডিওটি দেন। এর অংশবিশেষ আমরা দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টে প্রকাশ করি। এরপর ইসরাইল বিষয়টি স্বীকার করে নেয়। এর আগে জাতিসংঘ একাধিকবার ইসরাইলিদের বলে রেখেছিল এ শিবির শরণার্থীতে ভর্তি। লেবাননের শান্তি প্রক্রিয়ায় এই ছিল পেরেজের অবদান। পরে নির্বাচনে তিনি হেরে যান। সম্ভবত, এর পর আর কখনই তিনি ক্বানা নিয়ে খুব একটা ভাবেননি। কিন্তু আমি কখনই ভুলিনি। জাতিসংঘ শিবিরের প্রবেশদ্বারে যখন পৌঁছালাম, তখন সেগুলোর মধ্য দিয়ে তীব্র স্রোতে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছিল। এত বেশি যে, আমি রক্তের ঘ্রাণ পাচ্ছিলাম। আমাদের জুতা ধুয়ে যায় রক্তে, এরপর আঠার মতো লেগে ছিল। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে হাত, পা, বাহু, মস্তকবিহীন শিশুদের শরীর, বৃদ্ধ লোকের শরীরবিহীন মস্তক। এক লোকের শরীর দুই ভাগ হয়ে ঝুলছিল একটি ঝলসানো গাছে। তার শরীরের অবশিষ্ট যা-ই ছিল, পুড়ে ছাই হয়ে গেছে ততক্ষণে। ব্যারাকের দিকে পা বাড়াতে গিয়ে দেখা গেল, ছোট একটি মেয়ে এক লোককে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। পক্ককেশের লোকটির বাহু জড়িয়ে আছে মেয়েটি। লোকটির লাশ জড়িয়ে ধরে সামনে পেছনে দুলাচ্ছে মেয়েটি। মৃতদেহের চোখগুলো যেন মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটি ফুঁপিয়ে উঠছে আর কাঁদছে বারবার। ভেসে আসে দু’টো শব্দ: ‘আমার বাবা, আমার বাবা’। ওই মেয়েটি যদি আদৌ বেঁচে থাকে আজও, তবে আমার সন্দেহ হচ্ছে তার মুখ থেকে ‘শান্তিস্থাপক’ শব্দটি আজ আদৌ বের হচ্ছে কিনা। তবে সন্দেহ হচ্ছে মেয়েটি বেঁচে আছে কিনা আদৌ। কারণ বছর কয়েক পর ক্বানায় আবারও হত্যাযজ্ঞ চলে ইসরাইলি বিমানবাহিনীর নেতৃত্বে। জাতিসংঘ একটি তদন্ত চালায় ক্বানা হত্যাযজ্ঞের ঘটনায়। গড়পড়তা ভোঁতা শব্দে তদন্ত প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল যে, জাতিসংঘ বিশ্বাস করে না ওই হামলা একটি দুর্ঘটনা ছিল। পরে ওই প্রতিবেদনকে ‘ইহুদি-বিদ্বেষী’ বলে আখ্যা দেয়া হয়। এরও অনেক পরে, একটি সাহসী ইসরাইলি ম্যাগাজিন ক্বানায় হামলা চালানো একাধিক পদাতিক সেনাদের একটি সাক্ষাৎকার প্রচার করে। এক কর্মকর্তা ক্বানার গ্রামবাসীদের ‘স্রেফ একদল আরব’ (হিব্রুতে বলা হয় আরবুশিম) হিসেবে বর্ণনা দেয়। তার ভাষ্য, ‘কয়েকজন আরবুশিম মারা গেছে, এতে তো কোনো ক্ষতি নেই।’ পেরেজের চিফ অব স্টাফও প্রায় একই ধরনের ভাবনাহীন ছিলেন। ‘এ খেলার আর কোনো নিয়ম আমার জানা নেই, হোক সেটা ইসরাইলি সেনাবাহিনীর বেলায়, হোক সেটা বেসামরিক জনগণের বেলায়…’। নিজের লেবানন আগ্রাসনকে পেরেজ নাম দিয়েছিলেন ‘অপারেশন গ্র্যাপস অব র্যাথ’। জন স্টেনবেকের কাছ থেকে ধারণা না পেলে, এ নামটি নিশ্চিতভাবে এসেছে ‘বুক অব ডুটেরোনমি’ থেকে। বইটির ৩২ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে: ‘ত্রাসহীন আর ত্রাসের তরবারি তরুণ, আর কুমারী মেয়ে- উভয়কে ধ্বংস করবে। দুধের শিশু কিংবা পক্ককেশের পুরুষ- কেউই বাদ যাবে না।’ ক্বানা গ্রামের ওই ১৭ মিনিটের এর চেয়ে ভালো বর্ণনা আর কী হতে পারে? হ্যাঁ, পেরেজ পরের কয়েক বছরে পাল্টে গেছেন। ১৯৮২ সালে সাব্রা আর চৈতিলা গ্রামে খ্রিষ্টান মিত্ররা যখন ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছিল, তখন চুপ করে বসেছিল অ্যারিয়েল শ্যারনের সৈন্যরা। তার মৃত্যুর পর, লোকজন তাকেও ‘শান্তিস্থাপক’ বলে ডাকছিল। তিনি অন্তত নোবেল পুরস্কার জিতেননি। পেরেজ পরে ‘দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান’-এর পক্ষে অবস্থান নেন, যদিও ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইহুদি উপনিবেশ কেবল বাড়ছিল। এখন আমাদের অবশ্যই তাকে ‘শান্তিস্থাপক’ ডাকতে হবে। আগামী কয়েকদিনে পেরেজের মৃত্যু সংবাদে (অরবিচুয়ারি) কতবার ‘শান্তি’ শব্দটি উল্লেখ করা হয়, তা গুনতে থাকুন। এরপর গুনুন কয়বার ‘ক্বানা’ শব্দটি দেখা যায়।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.