চালে উদ্বৃত্তের দাবি শুভঙ্করের ফাঁকি,বছরে গড় ঘাতটি ৪৪লাখ টন
দেশের ঘাটতি পূরণে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ চাল-গম আমদানি হচ্ছে। বেসরকারি পর্যায়ে বৈধ ও অবৈধ দু’ভাবেই আসছে চাল ও গম। গবেষকদের মতে, ঘাটতি আছে বলেই ব্যবসায়ীরা চাল-গম আমদানি করছে। তবে খাদ্য ঘাটতির বিষয়টি সরকার স্বীকার করে না।
২০১৬-এর অর্থনৈতিক সমীক্ষায় দেয়া তথ্যানুযায়ী, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে চাল-গম মিলে আমদানি হয় প্রায় ৩০ লাখ টন। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৫৩ লাখ ৩১ হাজার টন খাদ্য আমদানি হয়। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত আমদানি হয়েছে ৩২ লাখ ১০ হাজার টন।
এই তিন অর্থবছরে মোট আমদানি হয় এক কোটি ১৫ লাখ ৪১ হাজার মেট্রিক টন। চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত ১৬ লাখ টন গম-চাল আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে।
ওই বছরগুলোতে ১৬ কোটি মানুষের চাহিদার ভিত্তিতে চালের ঘাটতি ছিল যথাক্রমে, ৪৭ লাখ ৭ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন, ৪৩ লাখ ৫৪ হাজার টন এবং ৪২ লাখ ৮৯ হাজার ২০০ টন। তিন অর্থবছরে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে এক কোটি ৩৪ লাখ ২১ হাজার মেট্রিক টন। চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের এখন পর্যন্ত ঘাটতির হিসাব চূড়ান্ত হয়নি।
চালে ঘাটতির কথা অস্বীকার করেছেন কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী।
সম্প্রতি তার কার্যালয়ে যুগান্তরের এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, প্রতি বছর আমাদের যে চাহিদা তৈরি হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি চাল উৎপাদন হচ্ছে। এতে উদ্বৃত্তের পরিমাণ বাড়ছে। ফলে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পেরেছে। ধান উৎপাদনেও দেশ বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে উঠে এসেছে।
বিপুল পরিমাণ উদ্বৃত্ত চাল থাকলে কেন বিদেশ থেকে আমদানি হচ্ছে জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী বলেন, ‘কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাজ হচ্ছে দেশে চালসহ সব ধরনের কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে দেশকে খাদ্যে উদ্বৃত্ত হতে সহায়তা করা। আমরা কৃষককে নানাভাবে প্রযুক্তি, প্রণোদনা দিয়ে এবং উৎসাহ জুগিয়ে সে কাজটি করে যাচ্ছি। কেন আমদানি হচ্ছে, তা আমি বলতে পারব না। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ই এটি ভালো বলতে পারবে।’
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরি যুগান্তরকে বলেন, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ অপ্রতুল হলেই ঘাটতি পরিস্থিতি তৈরি হয়। বিশ্বায়নের যুগে এ ঘাটতি মোকাবেলা করা হয় আমদানির মাধ্যমে। দেশে যে পণ্যের ঘাটতি আছে, চাহিদা বেশি ব্যবসায়ীরা মূলত সে ধরনের দ্রব্য সামগ্রীই বেশি আমদানি করেন। তবে এই আমদানির পরিমাণ কি হবে তা নির্ভর করছে বিশ্ববাজারে পণ্যের দামের ওঠানামা এবং দেশীয় বাজারে বিদ্যমান দামের ওপর। কারণ এখানে লাভালাভের বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দেশে খাদ্যপণ্যের দাম বেশি হলে এবং বিশ্ববাজারে কম থাকলে আমদানি বেশি হবে।
বিআইডিএসের জরিপ অনুযায়ী দেশে দৈনিক মাথাপিছু চালের চাহিদা ৪৬৩ গ্রাম। এ হিসাবে দেশে একদিনের জন্য চালের চাহিদা দাঁড়ায় ৭৪ হাজার ৮০ টন। ১৬ কোটি মানুষের বছরের চাহিদা দাঁড়ায় ২ কোটি ৭০ লাখ ৩৯ হাজার ২০০ মেট্রিক টন। ২০১৩-১৪ অর্থবছর ধান উৎপাদন হয় ৩ কোটি ৪৩ লাখ ৫৬ হাজার টন। এর থেকে চাল উৎপাদন হওয়ার কথা ২ কোটি ২৩ লাখ ৩১ হাজার ৪০০ টন। ফলে ওই বছর চালের ঘাটতি দাঁড়ায় ৪৭ লাখ ৭ হাজার ৮০০ টন।
২০১৪-১৫ অর্থবছরের দেশে প্রায় ৩ কোটি ৪৯ লাখ টন ধান উৎপাদন হয়। এ পরিমাণ ধানে চাল হওয়ার কথা ২ কোটি ২৬ লাখ ৮৫ হাজার টন। ১৬ কোটি মানুষের ৪৬৩ গ্রাম হিসাবে চাহিদা হচ্ছে বছরে ২ কোটি ৭০ লাখ ৩৯ হাজার ২০০ মেট্রিক টন। এতে চালে ঘাটতি দাঁড়ায় ৪৩ লাখ ৫৪ হাজার টন।
একইভাবে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৩ কোটি ৫০ লাখ টন। এর থেকে চাল হওয়ার কথা ২ কোটি ২৭ লাখ ৫০ হাজার টন। বছরে চাহিদা হবে ২ কোটি ৭০ লাখ ৩৯ হাজার ২০০ টন। ঘাটতি হওয়ার কথা ৪২ লাখ ৮৯ হাজার ২০০ টন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, খাদ্য ও নীতি সহায়তা সংস্থা এবং খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য পর্যালোচনা করেও ঘাটতির এমন তথ্যই পাওয়া গেছে।
সূত্র জানায়, ধানের প্রকৃত উৎপাদনকেই সরকার কাগজে-কলমে চালের প্রকৃত উৎপাদন হিসাবে দেখাচ্ছে। কিন্তু ধান থেকে সমপরিমাণ চালের উৎপাদন হচ্ছে না। ধান ভেঙে চাল করার সময় যান্ত্রিক উপায়েই তুষ ও কুঁড়া আলাদা হয়ে যাচ্ছে। এতে এক কেজি ধান থেকে মাত্র ৬৫০ গ্রাম চাল পাওয়া যাচ্ছে। অর্থাৎ ৪০ কেজি (এক মণ) ধানে ২৬ কেজি চাল মিলছে। ফলে চালের পরিমাণও কম হচ্ছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বরাত দিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দাবি করছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১০ লাখ ৮৪ হাজার টন চাল আমদানি হয়েছে। গম আমদানি হয় প্রায় ৩৮ লাখ টন। দেশে চাল-গমের আমদানি- এই ঘাটতি পরিস্থিতিই স্পষ্ট করছে। ঘাটতির কারণে এ সময়ে সরকারি-বেসরকারি মিলে ৪৮ লাখ ৭৪ হাজার টন চাল-গম আমদানি হয়। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে এ বছর ১৪ লাখ ৮ হাজার টন চালের এলসি খোলা হয় বলে জানা যায়। এ হিসাব সঠিক হলে চাল-গমের আমদানি বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৫২ লাখ টনের।
এছাড়া ২০১৫-১৬ অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত ৩ লাখ ৫৭ হাজার টন চাল দেশে প্রবেশ করেছে। একই সময়ে গম আমদানি হয়েছে ২৮ লাখ ৫৩ হাজার টন। কাগজে-কলমের এ হিসাবেও ঘাটতি দাঁড়ায় ৩২ লাখ ১০ হাজার টনের। এছাড়া ২০১৩-১৪ অর্থবছরেও দেশে বেসরকারিভাবে ১৩ লাখ ৭১ হাজার টন চাল আমদানি হয়।
অপরদিকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতির ৩ অক্টোবরের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ১২ হাজার টন চালের এলসি খোলা ও নিষ্পত্তি হয়। একই সময়ে গম আমদানি হয়েছে ৬ লাখ ৭৯ হাজার টন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকৃত তথ্যে আমদানির পরিমাণ আরও বেশি। কারণ সরকার ঘাটতির বিষয়টি স্বীকার করতে চায় না। কিন্তু ঘাটতি না থাকলে দেশে কোনো খাদ্যশস্যই আমদানির প্রয়োজন হতো না।
সূত্রমতে, চালের আমদানিতে উচ্চ শুল্ক ধার্য হলেও গম আমদানিতে শূন্য শুল্ক বহাল রয়েছে। চাল আমদানিকারকরা এ সুযোগটিই নিচ্ছেন। এ কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চালের চেয়ে গম আমদানি বেশি হচ্ছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা এ সুযোগ নিচ্ছেন। তারা মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে গম আমদানির নামে এলসি খোলে জাহাজীকরণের সময় গমের সঙ্গে চালও আনছেন। সেখানে ম্যানেজ ফর্মুলায় প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশন (পিএসআই) ছাড়াই এই চাল-গম খালাস হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, দেশে চালের বিপুল পরিমাণ উদ্বৃত্ত রয়েছে। চাহিদার চেয়ে বেশি চাল উৎপাদন হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ধান নয়, চাল উৎপাদন দেখায়। চালে আমরা উদ্বৃত্ত বলেই এখন সাধারণ মানুষের খাবার উপযোগী কোনো চাল দেশে আমদানি হচ্ছে না।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি দাবি করেন, যে চাল আমদানি হচ্ছে, সেগুলো বাসমতি ও কালিজিরার মতো খুবই উন্নত মানের। এর ভোক্তাও সাধারণ মানুষ নয়। তারকা হোটেলসহ, অভিজাত রেস্টুরেন্ট, বিয়েসহ নানা অনুষ্ঠানে ভূরিভোজের জন্য এ সুগন্ধিযুক্ত চাল ব্যবহার করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ রাইস মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সম্পাদক ও বাবুবাজার-বাদামতলীর মেসার্স সমতা ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী কাওসার আলম খান বাবলু যুগান্তরকে বলেন, সীমান্তবর্তী জেলার ব্যবসায়ীরাই চাল আমদানি বেশি করে। এসব এলাকার ব্যবসায়ীদের ভারতে নিজস্ব এজেন্ট বা তাদের ব্যবসায়ী স্বজন রয়েছে। দেশের পরিস্থিতি বুঝে তারা নানা কায়দায় চাল আমদানি করে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন যুগান্তরকে বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চায় দেশে সব ধরনের খাদ্যপণ্যের মজুদ একটি নিরাপত্তাস্তরে বজায় থাকুক। যাতে করে ভোক্তা পর্যায়ে এর সুফল পাওয়া যায়। তবে বেশি আমদানির মাধ্যমে দেশের কৃষি কিংবা শিল্প খাত যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে বিষয়টিও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এ কারণে ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে চাল আমদানিতে উচ্চশুল্ক বসানো হয়েছে। বিশেষ করে চাল আমদানির পরিমাণ যাতে কম হয়, তার জন্য খালাস পর্যায়ে বর্তমানে ২০ শতাংশ শুল্ক ধার্য রয়েছে।
ওদিকে চালের চাহিদা এবং জনসংখ্যার প্রকৃত তথ্য নিয়েও রয়েছে বিভ্রান্তি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দাবি করছে, মাথাপিছু দৈনিক চালের চাহিদা ৫৬২ গ্রাম। এতে ১৬ কোটি মানুষের দৈনিক চালের চাহিদা দাঁড়ায় ৯০ হাজার টন। বার্ষিক হিসাব দাঁড়ায় ৩ কোটি ২৮ লাখ ৫০ হাজার টনে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে দৈনিক চালের চাহিদা দেখানো হয় ৪১০ গ্রাম।
এছাড়া খাদ্যবিষয়ক সরকারের নীতি ও গবেষণা সংস্থা এফপিএমইউর মতে মাথাপিছু চাল-গমের চাহিদা ৪৬৪ গ্রাম। পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ অনুযায়ী মাথাপিছু ৪৯০ গ্রাম চাল-গম চাহিদা।
সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, এসব বিবেচনায় আনলে বিআইডিএসএর মাথাপিছু হিসাবটিই বেশি গ্রহণযোগ্য বলে ধরা যায়। এছাড়া সবকটি সংস্থার হিসাবকে আমলে নিয়ে গড় হিসাব বের করা হলেও মাথাপিছু ৪৪৫ গ্রামের কম হবে না।
বাংলাদেশ রাইস এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ও ডিসিসিআইর পরিচালক এমএস সেকিল চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, দেশে সাধারণত চাল আমদানি করা হয় ক্রাইসিস মুহূর্ত সামাল দিতে এবং দুই মৌসুমের মাঝের সময় সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.