কিলার তাকেই খুঁজছিল। সময় তখন ভর দুপুর। গলি দিয়ে হেঁটে হেঁটে বাসায় ঢুকেছিল। নিচতলার সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে উপরে উঠেছিল সে। কলিংবেলের শব্দ পেয়ে গৃহপরিচারিকা চামেলি দরজা খুলে দিয়েছিল। কিলারের কণ্ঠে জড়তা ছিল না। ভদ্রবেশী কিলার বলেছিল, ‘আন্টি আছেন? বাসা ভাড়া নেব।’ আন্টি বলতে ওই বাড়ির মালিক প্রকৌশলী কাজী মজিবুর রহমানের স্ত্রী জেবুন্নিসা চৌধুরী। এ বিষয়ে চামেলি জানান, কখনও মনে হয়নি লোকটি এরকম কিছু করতে পারে। দেখতে ভদ্রলোক। ইন করা শার্ট, শো-জুতা, কাঁধে ব্যাগ। ভদ্রবেশী কিলারের কথানুসারেই জেবুন্নিসাকে ডাকেন চামেলি। জেবুন্নিসা তাকে নিয়ে ফ্ল্যাট দেখাতে চতুর্থ তলায় যান। তারপর কি ঘটেছিল তা চামেলিসহ কেউ জানে না। গতকাল বৃহস্পতিবার দক্ষিণখানের আজমপুর মুন্সিমার্কেটের ৮১/৩৯ নম্বর ওই বাড়িতে গেলে কথা হয় জেবুন্নিসা চৌধুরীসহ তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। জেবুন্নিসার ছেলে কাওসার আহমেদ বাপ্পী জানান, একই ব্যক্তি হত্যা ও হত্যার উদ্দেশ্যে একের পর এক নারীদের ওপর হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। এই সিরিয়াল কিলার গ্রেপ্তার না হওয়া পর্যন্ত তারা কেউ নিরাপদবোধ করছেন না। ঘটনার দিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বাপ্পী জানান, দিনটি গত ৩১শে আগস্ট। দুপুর। খালাতো ভাই মেহেদি ও তিনি কিছুক্ষণ আগে বাইরে থেকে এসেছেন। ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গড়াগড়ি করছেন। ঠিক ওই সময়ে কলিংবেলের শব্দ শুনে চামেলি দরজা খুলে। বাপ্পীর মা জেবুন্নিসা ওই ব্যক্তিকে বাসা দেখাতে চতুর্থ তলায় নিয়ে যান। এর মধ্যে অফিস থেকে বাসায় ফিরেন জেবুন্নিসার স্বামী প্রকৌশলী মজিবুর রহমান। বাপ্পী বলেন, বাবা বাসায় এলে সবাই একসঙ্গে খাবার খাই। সেদিন খাবারের জন্য জেবুন্নিসাকে খুঁজছিলেন মজিবুর রহমান। আশপাশের কক্ষে জেবুন্নিসাকে না পেয়ে বাপ্পীর স্ত্রী মিতু আহমেদকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন ‘তোমার মা কোথায়’। মিতু বলেছিলেন, ‘ওপরে ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে কথা বলছেন হয়তো। আমি ডেকে আনছি।’ এ বিষয়ে মিতু বলেন, ফ্ল্যাট দেখাতে এতক্ষণ লাগার কথা না। তাই ভেবেছিলাম তিনি অন্যান্য ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলছেন। আমি মা, মা বলে ডেকেছি। কোনো সাড়া পাইনি। তারপর সিঁড়ি দিয়ে চতুর্থ তলায় যান মিতু। নিঃশব্দ। নতুন ওই ফ্ল্যাটটির দরজার বাইরে জেবুন্নিসার স্যান্ডেল। ভেতরে নিশ্চয় তিনি আছেন। হাঁটতে হাঁটতে মা বলে ডাকছিলেন না, কোনো শব্দ নেই। চাপানো দরজায় ধাক্কা দিতেই পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যায় মিতুর। রক্তে ভেসে গেছে পুরো কক্ষের মেজে। রক্তের মধ্যে অচেতন হয়ে হয়ে পড়ে আছেন জেবুন্নিসা। আরেকটি চিৎকার দেন মিতু। ওই চিৎকার পুরো বাড়িটি যেন কাঁপিয়ে দেয়। এমনটিই বলছিলেন বাপ্পীসহ বাড়ির বাসিন্দারা। মিতু বলছিলেন, ‘মাকে মেরে ফেলছেরে, মাকে মেরে ফেলছে।’ এই চিৎকার শুনে বের হয়েছিলেন চতুর্থ তলার একটি ফ্ল্যাটের বাসিন্দা ডালিয়া রহমানও। ডালিয়া বলেন, এর আগে কোনো শব্দ পাননি তিনি। মিতুর চিৎকার শুনে মজিবুর রহমান, বাপ্পী ও বাপ্পীর খালাতো ভাই মেহেদিসহ সবাই চতুর্থ তলায় ছুটে যান। রক্তাক্ত জেবুন্নিসাকে উদ্ধার করে উত্তরার একটি বেসরকারি মেডিকেলে নিয়ে যান। সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয় জেবুন্নিসাকে। পরে ভর্তি করা হয় পান্তপথের একটি বেসরকারি মেডিকেলে। এক মাস চার দিন হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে তাকে। এর মধ্যে নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে রাখা হয়েছে ২২ দিন। জেবুন্নিসা বেঁচে আছেন। কিন্তু সুস্থ হননি। যেন মরে মরে বেঁচে আছেন। এক সময়ের সুস্থ-সবল মানুষটির এখন পুরো সময় কাটে বিছানায়। শরীরের ডান দিক অবশ হয়ে আছে। বাম দিকও দুর্বল। দু’চোখে প্রায় দেখেন না। এমনকি স্মৃতিশক্তিও লোপ পেয়েছে তার। কি হয়েছিল আপনার? জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটা এক্সসিডেন্ট হয়েছিল। কেউ মেরেছিল? জানতে চাইলে-থেমে যান। যেন কিছুই মনে নেই তার। জেবুন্নিসার স্বামী প্রকৌশলী মজিবুর রহমান জানান, এই ঘটনার পর ৪ঠা সেপ্টেম্বর দক্ষিণ খান থানায় মামলা করেছিলেন তিনি। কিন্তু আজ পর্যন্ত কিলারকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। মজিবুর রহমানের ধারণা, প্রতিটি হামলা ও হত্যার ঘটনা উত্তরার এই এলাকাতেই ঘটেছে। তাই কিলার এই এলাকাতেই আছে। তিনি জানান, তার কোনো শত্রু নেই। জেবুন্নিসা একজন সরল মনের নারী উল্লেখ করে তার স্বামী মজিবুর রহমান বলেন, তিনি দিনের বেশির ভাগ সময় কাটান ইবাদত করে। কারও সঙ্গে তার শত্রুতা নেই। তাকে কেন এভাবে হামলা করবে তা ভেবে পাচ্ছেন না তিনি। তার পরিবারের সদস্যরা আতঙ্কে আছেন বলে জানান মজিবুর রহমান। একইভাবে তার ছেলে বাপ্পী বলেন, কিলার যদি সাইকো হয় তাহলে এটা আরো ভয়ঙ্কর ব্যাপার। সে যে কোনো সময় অন্যদের উপরও হামলা করতে পারে। এ বিষয়ে দক্ষিণখান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শেখ রোকনুজ্জামান জানান, জেবুন্নিসাকে হামলার খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। আলামত হিসেবে সেখানে থেকে একটি স্কুল ব্যাগ ও লোহার চাপাতি জব্ধ করা হয়েছে। এ ছাড়াও ওই বাড়ির গলির বিভিন্ন স্থান থেকে সিসিটিভির ফুটেজ উদ্ধার করে তা পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। শেখ রোকনুজ্জামান বলেন, যে কোনো কারণে ওই কিলার বাড়ির নারী মালিকদের উপর ক্ষুব্ধ হয়ে বিভিন্ন হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে। এর মধ্যে দুটি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে এই সিরিয়াল কিলার। পুলিশির তৎপরতার কারণে এখন সে আড়ালে চলে গেছে। তবে তাকে গ্রেপ্তার করতে পুলিশি তৎপরতা অব্যাহত আছে বলে জানান তিনি।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.