রাজধানীর ঢাকার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু নদী। নদীগুলো এক সময়ের প্রধান যাতায়াতের পথ হলেও দখল ও দূষণে এখন ধুঁকছে। কোথাও বালি ফেলে ভরাট করেছে প্রভাবশালী দখলদাররা। কোথাও আবার কলকারখানার রাসায়নিক বর্জ্য ফেলে নষ্ট করছে নদীর পানিসহ পরিবেশ। বিপজ্জনক প্রতিবেশে জীবনীশক্তি শেষের পথে নদী তলদেশের জীববৈচিত্র্যের। নদীগুলো মাঝেমধ্যে দখলমুক্ত করতে সরকার উদ্যোগ নিলেও বিভিন্ন সময় দখল মুক্ত করার অভিযান চালালেও অভিযানের পর আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়। আগের মতোই হামলে পড়ে দখলবাজরা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আমির হোসেন ভূঁইয়া ও তার ছাত্র মো. আশরাফুল ইসলাম চৌধুরী সাগরের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার চারপাশের বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগ ও শীতলক্ষ্যা নদীর ২৫০ একরের বেশি জায়গা দখল হয়েছে এক যুগের কিছু বেশি সময়ে। ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব জিওম্যাট্রিকস অ্যান্ড জিওসায়েন্সে প্রকাশিত এই গবেষণায় বলা হয়েছে আবাসিক ভবন, শিল্প-কারখানা, ইটভাটা, মোবাইল টাওয়ার, কয়লা ও সিমেন্ট ব্যবসা, মার্কেট এবং দোকানপাট নির্মাণ করে নদীগুলো দখল করা হয়েছে। এ ছাড়া সড়ক, নৌঘাট, জাহাজ নির্মাণ কারখানাও তৈরি করেও নদী দখল করা হয়েছে। এর মধ্যে নদী দখল করে সবচেয়ে বেশি অবকাঠামো গড়া হয়েছে কামরাঙ্গীরচর ও বসিলায়। এই অংশে ৫০ থেকে ৫৬ শতাংশ এলাকা দখল করা হয়েছে। এ ছাড়া আবদুল্লাহপুর, গাবতলী, ডেমরা, কাঁচপুর ও নারায়ণগঞ্জ এলাকায় ৩৮-৪৮ শতাংশ স্থানে বিভিন্ন অবকাঠামো গড়ে দখল করা হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপার কয়েকজন গবেষকের প্রতিবেদনে ঢাকার চারপাশের নদী দখলের ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপার গবেষক শরিফ জামিলের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার প্রাণখ্যাত বুড়িগঙ্গা নদীর বসিলা থেকে ধলেশ্বরী নদী পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার নদীপথের দুই পাড়ই দখল করে ফেলেছে প্রভাবশালীরা। নদীর সীমানা পিলার পর্যন্ত এমনকি কোথাও সীমান পিলার অতিক্রম করে দখল করা হয়েছে। কামরাঙ্গীরচর থেকে সদরঘাট পর্যন্ত নদীর দুই পাশে পাড় বাঁধানো থাকলেও থেমে নেই দখল। জমি দখল করতে না পেরে বাঁধানো পাড় দখল করেছে প্রভাবশালীরা। হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্প-কারখানাসহ অন্যান্য শিল্পবর্জ্যে ভরাট হওয়ার পথে প্রায় নদীটি। বিভিন্ন জায়াগায় দখল করা জায়গায় শিল্প-কারখানার বর্জ্য ফেলা হয়। বুড়িগঙ্গায় এখন পর্যন্ত যাত্রী ও মালামাল পরিবহন অব্যাহত থাকলেও জেলেদের দেখা মেলে না বললেই চলে। শুকনো মৌসুমে দুর্গন্ধে নদীর আশপাশ দিয়ে চলা কঠিন হয়ে পড়ে। অধ্যাপক ড. আমির হোসেন ভূঁইয়ার গবেষণায় দেখানো হয়েছে সবচেয়ে বেশি দখল হয়েছে বুড়িগঙ্গা। কামরাঙ্গীরচর থেকে বসিলা পর্যন্ত ৭ দশমিক ৪১ মাইল এলাকায় নদীটি দখল হয়েছে ৯৭ দশমিক ১৭ একর। স্থানীয়দের কাছে তুরাগ নদীর নাম ছিল ‘কহর দরিয়া’। অর্থ দাঁড়ায় ‘কষ্টের সাগর’। টঙ্গী থেকে আশুলিয়া পর্যন্ত বিশাল জলরাশি পার হতে এলাকাবাসীর অনেক কষ্ট পেতে হতো বলে এমন নাম ছিল। বিশাল এই কষ্টের দরিয়া এখন সরু খাল। বাপার শরিফ জামিলের প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, তুরাগ নদীর ধলেশ্বরীর মিলনস্থল পর্যন্ত ৩ কিলোমিটার পুরোটাই বিভিন্নভাবে দখল করে নিয়েছে প্রভাবশালীরা। এছাড়া, দখলের হাত থেকে বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যয় ও আদালতের নির্দেশে ২০১৩ সালের আগে নদী টাস্কফোর্স নদীর সীমানা পিলার বসানোর উদ্যোগ নেয়। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক ডা. মো. আবদুল মতিনের এক গবেষণায় দেখা যায়, নদীর সীমানা নির্ধারণের জন্য প্রায় দুই হাজার পিলার বসানো হয়েছে তুরাগ নদীর পাড়ে। এর মধ্যে আদালতের রায় মেনে বসানো হয়েছে মাত্র ২৯টি। ৯৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ পিলার বসানো হয়েছে ফোরশোরে বা নদীর ঢালে। সঠিকভাবে রায় না মানার ফলে আমিনবাজার সেতু থেকে উত্তরা টঙ্গী সেতু পর্যন্ত ২০ কি.মি. দীর্ঘ নদীর দুই পাড়ের মোট ৫ কোটি ২৩ লাখ বর্গফুট অতি মূল্যবান জমি নদীর হাতছাড়া হয়ে গেছে। ফলে পুরাতন ও নতুন দখলদাররা আবার নদী দখলে মেতে উঠেছে। তবে অধ্যাপক ড. আমির হোসেন ভূঁইয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তুরাগ নদের আবদুল্লাহপুর থেকে গাবতলী পর্যন্ত ৫ দশমিক ৭৬ মাইল এলাকাজুড়ে নদীটির দখল হয়েছে ১২০ দশমিক ৭৯ একর। টাঙ্গাইলের উজানে লৌহজং নদী ভাটিতে এসে তুরাগ নাম ধারণ করলেও এটি মূলত বংশী নদীর শাখা। টাঙ্গাইল জেলা থেকে এসে দরিরামপুরের কাছে ঢাকা জেলায় প্রবেশ করেছে নদটি। এটি কালিয়াকৈর, মির্জাপুর, গাজীপুর, সাভার, মিরপুর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মোহাম্মদপুরের ভেতর দিয়ে বুড়িগঙ্গায় গিয়ে মিশেছে। দৈর্ঘ্য ৭১ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ২১৮ মিটার, গড় গভীরতা ১৩.৫ মিটার। তুরাগ নদীর অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে নদটি। একসময় সারা বছরই এ নদে পানিপ্রবাহ থাকলেও এখন তার ঐতিহ্য হারিয়ে ছোট খালে পরিণত হয়েছে। ঢাকার উত্তর-পূর্ব এলাকা দিয়ে প্রবাহিত বালু নদ। বেলাই বিল ও ঢাকার উত্তর-পূর্বের বিস্তীর্ণ জলাভূমির ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ডেমরার কাছে শীতলক্ষ্যা নদীতে গিয়ে মিশেছে এটি। শীতলক্ষ্যার সঙ্গে কাপাসিয়ার কাছে সুতি নদীর মাধ্যমে এর একটা যোগাযোগ রয়েছে। তবে বর্তমানে এই নদের নাব্যতা নেই বললেই চলে। দখলে-দূষণে নদীটি বর্তমানে মৃতপ্রায়। বর্ষা মৌসুমে বালু নদ শীতলক্ষ্যা ও তুরাগের পানি বহন করে বলে বেশ প্রাণবন্ত থাকে। তবে শুকনো মৌসুমে অনেক জায়াগায় হেঁটে পার হওয়া যায়। বছরে ছয় থেকে সাত মাসই পানিশূন্য থাকে। নাব্যতা সংকটে এখন বালু নদে নৌচলাচলও কঠিন হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপার গবেষণায় দেখা গেছে ৩৬ কিলোমিটার এ নদের ২২ কিলোমিটার এলাকাই দখলদারদের আওতায় চলে গেছে। শুকনা মৌসুমে পানি আলকাতরার মতো কালো হয়ে যায়। গবেষণায় দেখানো হয়েছে, পশ্চিমগাঁও, নাওরা, কায়েতপাড়া, ধীৎপুর দক্ষিণপাড়া ও কেওঢালা গ্রামের অনেক স্থানে বালু নদীর তীরবর্তী স্থান দখল-ভরাট করে বাড়িঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া, বালু নদীর নড়াইমুখ এলাকায় সবচেয়ে বেশি দখল-ভরাট হচ্ছে। ড. আমির হোসেন ভূঁইয়ার গবেষণা বলছে, ডেমরা থেকে নন্দীপাড়া পর্যন্ত ৪ দশমিক ২ মাইলজুড়ে বালু নদ দখল হয়েছে। বুড়িগঙ্গা ও তুরাগের যথাক্রমে ২৩ দশমিক ৮৩ ও ৮ দশমিক ৮৪ একর দখল করা হয়েছে। সব মিলিয়ে দখল করা হয়েছে ২৫০ দশমিক ৬৩ একর নদী।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.