ভোরের নরম লীলাভ আলোতে চোখের সামনে একফালি সবুজ মাঠ। চার পাশে পাহাড় আর সবুজের সমারোহ। দূর পাহাড়ের মাথায় মেঘের জটলা। বাঁশঝাড় থেকে একদল পাখি উড়ে গেল ট্যাঁ ট্যাঁ করতে করতে। এরকম একটি পরিবেশে রাঙ্গামাটির পাহাড়িরা উদযাপন করেছেন নববর্ষ। সেখান থেকে ঘুরে এসে লিখেছেন আলমগীর কবির হৈ হুল্লোড় করে চার পাঁচজনের একটি দল এসে উঠল নৌকায়, একজন আরেকজনকে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে। পেছন থেকে বিরক্তিকর সুরে একজন বলল, ভাই, নৌকায় এসব বন্ধ করুন। পাঁচজনের দল থেকে একজন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বললেন, ভাই আজকে তো সাংগ্রাই (মারমাদের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান), সবাই মিলে একটু মজা করব না? এবার পেছন থেকে জবাব, কিন্তু আপনাদের লোকজনই তো বলল, মূল আয়োজনের সময় শেষ, তাই আমাদের কেনা পানির বোতলটাও রেখে দেয়া হয়েছে। কাপ্তাইয়ের চিমর এলাকায় অবস্থিত চিংম্রং বৌদ্ধবিহার থেকে ফেরার পথে কর্ণফুলী নদী পাড়ি দেয়ার সময় গত ১৫ এপ্রিল নৌকায় বসে এই কথোপকথন শুনছিলাম। ছোট্ট নদী অথচ পারাপারে জনপ্রতি ভাড়া নেয়া হয় ১০ টাকা করে। স্বাভাবিকভাবে এই গুদারা ভাড়া আরো কম হলেও সাংগ্রাই চলাকালে ভাড়া বাড়ানো হয় বলে জানিয়েছেন তালা মারমা। তিনি ওই হৈ হুল্লোড় করে নৌকায় ওঠা পাঁচজনের একজন। নৌকা থেকে নামার পর খুব বিনয় নিয়ে বললেন, ‘আপনারা ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ হওয়াতে হয়তো কেউ পানির বোতলটা ফাজলামো করে নিয়ে নিয়েছেন, আসলে সাংগ্রাই চলাকালে সারা দিনই পানি ছিটাছিটি চলে। আগামীকাল (১৬ এপ্রিল) রাঙ্গামাটিতেও এই আয়োজন করা হবে। আপনারা অবশ্যই যাবেন।’ তালা মারমার সাথে থাকা বাকি চারজনও খুব বিনয়ের সাথে তাদের অনুষ্ঠানে যাওয়ার নিমন্ত্রণ করলেন। তবে পানি ছিটিয়ে দেয়ার এই আয়োজনটা যে পাহাড়িরা খুব উপভোগ করে সেটা কাপ্তাই থেকে সিএনজিতে করে চিমর যাওয়ার পথেই টের পাওয়া গিয়েছিল। চিমর প্রবেশের এক কিলোমিটার আগে থেকেই রাস্তার দুই ধারে ছোট ছোট ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে তরুণ-তরুণীরা পানি ছিটাতে থাকে। সিএনজির সামনের দিকে যদি কেউ বসেন, মূল জায়গায় প্রবেশের আগে আধো ভেজা হয়ে যাবেন সেটা নিশ্চিত।
নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা রাঙ্গামাটিতে এই আনন্দকে বোনাস হিসেবে ধরে নেয়া ভালো। কারণ পানি ছিটানোর মূল উৎসবটা হয় বান্দরবানে মারমা প্রধান এলাকায়। উপজাতিদের মধ্যে রাঙ্গামাটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ চাকমারা। তারা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানকে বলে বিজু উৎসব। পয়লা বৈশাখের দিন সকালে রাঙ্গামাটির রাজবন বিহার মাঠে এ উপলক্ষে সবচেয়ে বড় আয়োজন করা হয়। যেখানে তাদের ধর্মীয় নেতারাসহ ধনী, গরিব সবাই একসাথে মিলিত হয়ে প্রার্থনা করেন। রাজবন বিহার থেকে দুই টাকা গুদারা ভাড়া দিয়ে যাওয়া যায় চাকমাদের রাজার বাড়িতে। একটা দ্বীপের মাঝে থাকা রাজার মূল বাড়িটা কয়েক বছর আগে আগুনে পুরে গেলেও পর্যটকেরা সীমানা প্রাচীর দেখে মুগ্ধ হবেন। রাজবাড়ির পাশে রয়েছে একাধিক বৌদ্ধমন্দির। এর আশপাশে থাকা বাড়িগুলোতে বিজুর দিনে যে কেউ আতিথেয়তা পাবেন। রাজার বাড়ির একটু সামনে ছোট্ট এক ঢেরা ঘর থেকে যখন আমাদের ১২ জনের গ্রুপকে আপ্যায়ন করা হয়েছিল, অবাক না হয়ে উপায় ছিল না। কারণ পরিবারটি যে আর্থিকভাবে সচ্ছল নয় সেটা বোঝাই যাচ্ছিল; কিন্তু মানসিকভাবে পরিবারটি অনেক বড়, উদার সেটা বোধ হয় আলাদা করে বলার কিছু নেই।
বিষয়গুলো আমাদের সামনে সুন্দরভাবে বর্ণনা করছিলেন, ঈশ্বর চন্দ্র চাকমা। বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডে চাকরি করেন তিনি। আমাদের টিমের একজনের সহকর্মী হওয়ায় তার বাসায় দাওয়াত ছিল সবার। ভদ্রলোক তিন কন্যার জনক। নতুন কারো সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার পর পায়ে ধরে সালাম করার রেওয়াজ তাদের মধ্যেও রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পর তাদের রাজা ত্রিদিব কেন পাকিস্তানে চলে গেছেন, পরে তার ছেলে রাজা দেবাশীস রায় কিভাবে হাল ধরেছেন, আর বিজু উৎসবে তারা কিভাবে আনন্দ করেন সে সবের বর্ণনা করছিলেন তিনি। তবে একটি দ্বীপের মাঝে তাদের বসতি হওয়ায় চলাচলটা একটু কঠিন। ছোট একটা ব্রিজ হলে যাতায়াতে অনেক সুবিধা হতো। সরকারের পক্ষ থেকে কয়েকবার উদ্যোগও নেয়া হয়েছিল একটি ব্রিজ করার জন্য কিন্তু তাদের রাজা আপত্তি তোলায় সেটা আর হয়নি। চলাচলে কষ্ট হলেও এ নিয়ে রাজার প্রতি কোনো ক্ষোভ নেই তাদের। ঈশ্বর চাকমা বলেন, ‘ব্রিজ হলে আমাদের অনেক সুবিধা হতো, কিন্তু রাজা যে যুক্তি দিয়েছেন ব্রিজ হলে এখানে গাড়ি আসবে, আশপাশের অনেক মানুষ রাত-বিরাতে এখানে আসবে, এতে নিরাপত্তা অনেক কমে যাবে। এখন আমরা দরজা জানালা খুলে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারি। বাইরে যেকোনো জিনিস রেখে দিতে পারি। এতে কেউ নিয়ে যাওয়ার ভয় থাকে না।
ব্রিজ হলে হয়েতো এই প্রশান্তিটা আমরা পেতাম না।’ তার বাড়ি ১০-১২ রকমের আইটেম দিয়ে আমাদের আপ্যায়ন করা হয়েছিল। রাতে ফেরার সময় গুদারা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসেছিলেন মেয়েও। আসলে এখানে তাদের ভ্রাতৃত্ববোধের বিষয়টিই সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় ছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের বর্ষবরণের ঐহিত্যবাহী অনুষ্ঠানকে সম্মিলিতভাবে বলা হয় বৈসাবি। বৈসাবি নামকরণও করা হয়েছে এ তিনটি উৎসবের প্রথম অক্ষর নিয়ে। ‘বৈ’ শব্দটি ত্রিপুরাদের বৈসু থেকে, ‘সা’ শব্দটি মারমাদের সাংগ্রাই থেকে এবং ‘বি’ শব্দটি চাকমাদের বিজু থেকে। এই তিন শব্দের সম্মিলিত রূপ হলো ‘বৈসাবি’। রাঙ্গামাটিতে সবচেয়ে সুন্দর সময় কাটবে কাপ্তাই লেকের ওপর দিয়ে নৌকাতে ভ্রমণের সময়। স্বচ্ছ টলমল পানিতে যখন নৌকা চলবে মনে হবে পর্যটকদের স্বাগত জানাতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়গুলো।
সিলেটে গেলে যারা প্রতিবেশী দেশের পাহাড় দেখে আফসোস করে বলেন, ‘ওই বড় পাহাড়গুলোতে যদি যাওয়া যেত!’ বর্ষাকালে সুভলং যাওয়া পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হলেও গ্রীষ্মকালে ঝরনার পানি না থাকায় সেখানে লোকজন খুব একটা ভিড় জমায় না। আমরাও সেই পথ অবলম্বন করলাম। তবে প্রকৃতির মাঝে ভাসমান একটি পাহাড়ি দ্বীপে পেদা টিং টিং রেস্তোরাঁয় খাবারের পরিবেশটা ছিল মনোমুগ্ধকর। এই দ্বীপে যতক্ষণ থাকা যাবে, মনে হবে নিজের পরিচিত পরিবেশ থেকে অনেক দূরের কোনো স্বপ্নের জায়গায় চলে এলাম। তবে এই স্বপ্নে বিভোর হলে চলেবে না, খাবার অর্ডার করার পূর্বে অবশ্যই তালিকার পাশে লেখা দামটার দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.