ঘণ্টা দুই পেরোনোর পর সবুজ পাহাড় চিড়ে ঝরনার পানি বয়ে যেতে দেখলাম। আচমকাই মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, এত পানি কই যায়? চালকের আওয়াজ, ‘স্যার, সামনে তিস্তা নদী।’ ঠিক তাই। কী অদ্ভুত দৃশ্য! এ পাশে পাহাড় আর অন্য পাশে দুরন্ত তিস্তা। মাঝের রাস্তা দিয়ে আমরা ছুটে চলেছি। এই পথের যেন শেষ নেই। আঁকাবাঁকা পাহাড়ের সঙ্গে তিস্তার পাল্লা দেওয়া। দার্জিলিং আর ক্যালিম্পংকে মাঝখান দিয়ে চিড়ে দিয়েছে এই নদী। তিস্তা পেরোনোর পর এবার আমাদের ওপরে ওঠা। গোর্খারাজ্যের ক্যালিম্পং শহরটা যে ওপরে। এ শহরটা বেশ ছিমছাম।
পাহাড়ি জীবন মনে হয় পাহাড়ের মতোই শান্ত। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে একঝাঁক শিশু কোট-টাই পরে স্কুলে যাচ্ছে। অথবা হঠাৎই রাস্তার পাশে মুড়োর মোমো দোকানে আড্ডা। কোনো কোলাহল নেই। নেই কোনো গাড়ির হর্নের বিকট আওয়াজ। শহরকে পাশে কাটিয়ে আমরা পাহাড় টপকে ওপরে উঠছি। আগেই জেনেছিলাম, দেলো ক্যালিম্পংয়ের সবচেয়ে ওপরে। অর্থাৎ দেলো পাহাড়ের চূড়ায়। ক্যালিম্পং শহর থেকে যার উচ্চতা ৫ হাজার ৫৯০ ফুট। উচ্চতার এই হিসাব-নিকাশে আগেই বুঝেছিলাম মেঘ ছোঁয়ার সুযোগটা হাতের মুঠোয়। সত্যিই তাই। যত ওপরে উঠছি, গাড়ির জানালা দিয়ে তুলার মতো মেঘ আমাদের ছুঁয়ে ছুঁয়ে স্বাগত জানাচ্ছে। নেশা লেগে যায়। ঠিক এ রকম সময়ে বেরসিকের মতো চালকের হঠাৎ হার্ড ব্রেক। জানালা দিয়ে তাকাতেই দেখি, মেঘের কোলে অনিন্দ্য সুন্দর এক বাড়ি। জানা গেল এই বাড়িটায় আছে একেবারে ভিন্ন এক ক্যাকটাস বাগান। দেলো যাওয়ার পথে এই ক্যাকটাস বাগান ভ্রমণপিপাসুদের মন ভরিয়ে দেয়। সবাই হইহুল্লোড় করে নামলাম সেই ক্যাকটাস বাগানে। ১০ রুপি টিকিটের বিনিময়ে বাগানে ঢুকে মনে হলো, নাহ্, পয়সা উশুল। এ রকম ক্যাকটাস বাগান সচরাচর দেখা যায় না। সারি সারি বিশালকায় ক্যাকটাস গাছ অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাগানের চারদিক দিয়ে ঘেরা বিভিন্ন রঙের উচ্চতায় ক্যাকটাস। বাগানের রক্ষণাবেক্ষণের কাজে যাঁরা আছেন, তাঁদের কাছ থেকে জানা গেল, ক্যাকটাসের এই বাগানে বিভিন্ন প্রজাতির ক্যাকটাসের চাষ হয় এবং তা বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করা হয়।
ভ্রমণবিলাসীরা এখানে ঘুরতে আসেন, বিশ্রাম নেন আর বিদায়বেলায় সঙ্গে করে নিয়ে যান রংবেরঙের ক্যাকটাস। ছবি তোলা আর ক্যাকটাস বিচরণে এতই মগ্ন ছিলাম যে ওইদিকে সূর্য যে হেলে পড়ছে, তা খেয়ালই করিনি। সংবিৎ ফিরে পেলাম ড্রাইভারের হর্নে। দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমাদের আরও ওপরে উঠতে হবে। ৫ হাজার ৫৯০ ফুট। জানি না এখন আমরা কত উঁচুতে আছি। তাই আবার ছুটে চলা ওপরে। বেঁকে যাওয়া পাহাড়ি রাস্তায় আরও পেরিয়ে গেল এক ঘণ্টা। সমতল এক জায়গায় ড্রাইভারের কষে ব্রেক। বিশালকায় এক লোহার ফটক। চারদিক সুনসান নীরবতা। গেটজুড়ে লাল রঙের সাইনবোর্ড। ইংরেজিতে লেখা, ‘স্বাগত দেলো ট্যুরিস্ট কমপ্লেক্স’। অর্থাৎ আমরা পৌঁছে গেছি। ক্যালিম্পংয়ের দেলো পাহাড়ের চূড়ায়। গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের তত্ত্বাবধানে পর্যটন বিভাগ এই দেলো ট্যুরিস্ট কমপ্লেক্সটি দেখাশোনা করে। পাহাড়ের চূড়ায় প্রায় ৫৭ একর ভূমি নিয়ে এই বিশাল ট্যুরিস্ট কমপ্লেক্সটি আবাসিক অথবা অনাবাসিক ভ্রমণবিলাসীদের জন্য। আমরা যেহেতু বুকিং দিয়ে আসিনি, তাই আমরা অনাবাসিক। ২০ রুপি প্রবেশ ফি। বিশাল গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই বড় চমক। সারি সারি সবুজ বাগান। মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। তৈরি করা পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যত উপরে উঠছি, মেঘ এসে নাকে-মুখে লাগছে। যেন উপরে উঠতে উঠতে মেঘের রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া। মেঘ যেন ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অন্য এক ভুবনে। পাহাড়ি ঢাল দিয়ে উপরে উঠে পৌঁছলাম এক সমতল জায়গায়। এখানেই আছে বিশাল ট্যুরিস্ট লজ। চোখ জুড়ানো এই লজে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপারটি হচ্ছে নীরবতা। কোথাও কোনো শব্দ নেই। মনে হয় মেঘের বাড়িতে বেড়াতে এসে সুনসান এই ভুবনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিই। বিশাল ঘন সবুজ মাঠের পাশে এই লজে যাঁরা বুকিং দিয়ে আসবেন, তাঁদের জন্য রয়েছে চমৎকার থাকা এবং খাওয়ার ব্যবস্থা।
আক্ষরিক অর্থেই ছুটি কাটানোর এ রকম চমৎকার স্থানের কোনো তুলনাই হয় না। দেলো ট্যুরিস্ট কমপ্লেক্সের সবচেয়ে আকর্ষণ উপভোগ করার ব্যাপারটি হচ্ছে, সুউচ্চ এই দেলো পাহাড় থেকে পশ্চিম সিকিম পুরোটা দেখা যায়। অভূতপূর্ব দৃশ্য। সিকিমের সৌন্দর্য উপভোগ দেলো পাহাড় থেকেই কিছুটা হলেও অনুধাবন করা যায়। বিভিন্ন রঙের ফুলের বাগানে দাঁড়িয়ে মেঘের ভেলায় ভেসে সিকিম দেখা যেন এক দারুণ অনুভূতি। এই অনুভূতির রেশ নিয়ে বারবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে দেলো পাহাড়ে।
যেভাবে যাবেন
দার্জিলিং থেকে ক্যালিম্পং বাসে যেতে পারেন। ভাড়া ১৫০ রুপি। ক্যালিম্পং থেকে সুমো গাড়িতে দেলো পাহাড়। যদি ছয়জনের দল হয়, তাহলে সুমো পুরোটা ভাড়া করে নিয়ে যেতে পারেন। ভাড়া পড়বে এক হাজার রুপি। এ ছাড়া দার্জিলিং থেকেও গাড়ি ভাড়া করতে পারেন। আসা-যাওয়ায় ভাড়া পড়বে ১ হাজার ৭০০ রুপি। দেলো ট্যুরিস্ট লজে বুকিং দিতে হবে ভ্রমণ আয়োজকদের মাধ্যমে।
অবশ্যই শীতের কাপড় নিয়ে নেবেন সঙ্গে। কারণ, মেঘের রাজ্যে ঠান্ডাটা একটু বেশিই পড়ে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.