ওরেগন থাকতেই অনলাইনে ভিক্টোরিয়া ভ্রমনের টিকেট কেটেছিলাম ৯৮ ইউ.এস ডলারে। সন্ধ্যায় ট্রাভেল কোম্পানীকে ফোন করে নিশ্চিত হলাম যে সঠিক সময়েই ভ্রমন হবে।
সকাল ৭টায় ক্যামবী স্ট্রিটের ওকরিজ শপিং সেন্টারে সামনে থাকতে হবে। ওখানেই তাদের বিশেষ বাস এসে নিয়ে যাবে। রাতেই রেডী হলাম। বলাই বাহুল্য যে ব্যাকপ্যাকে খাবারই বেশী ছিলো। নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হলাম। ওয়েবসাইটে দেখেছিলাম ছাদখোলা ডাবল ডেকার বাসে চড়ে পর্যপকরা প্রকৃতি দর্শন করছে। ভেবেছিলাম সেরকম কোনো বাস আসবে। কিন্তু অবাক করে দিয়ে যা আসল,তার জন্যে প্রস্তুত ছিলাম না। আসল একেবারে ছোট এক ধরনের বাস,যার ভেতরে ২০টা সিট। এই বাস মোটেও পছন্দ হলনা। ড্রাইভার হল চাইনিজ,সে ইংরেজী বলার সময় নিজের জান বের করে ফেলে এমন অবস্থা। দেখলাম তার বাসের বেশীরভাগ সিট দখল করে আছে চায়নিজরা। বুঝলাম এটা চায়নিজদের ট্রাভেল ব্যবসা। আর চায়নিজরা অন্য চায়নিজদের পছন্দ করে,ফলে সার্ভিস মোটামুটি হলেই তাদের চলে,কারন টাকাটা তো নিজেদের লোকের পকেটে যাচ্ছে।
সামনের দিকের একটি সিট পেলাম। সিটটা পছন্দ হল। পছন্দসই বাস না পেলেও এতেই মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। বাস চলতে শুরু করল,ভালো লাগল। রিভার রক নামক একটি কেসিনোর সামনে বেশ কিছুক্ষন থেমে সেখান থেকেও কিছু যাত্রী তুলল। এরপর ভিক্টোরিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করল।
আজ অত্যন্ত দারুন রৌদ্র ঝলমলে দিন। আবহাওয়া চমৎকার। একেবারে গতকালের বিপরীত। গতকালের ছাতি দিয়ে আকাশ ফুটো করা লোক আজ পালিয়েছে। ঘন্টা খানেকের মধ্যে সমুদ্র তীরের ফেরীঘাটে পৌছলাম। আমার মনে হচ্ছিলো ছোট খাটো কোনো ফেরী হয়ত আসবে,উঠে যাব। কিন্তু যা দেখলাম তাতে চক্ষু চড়কগাছ। ৫তলা বিশিষ্ট বিশাল এক জাহাজ। প্রথম ৩টি ফ্লোরে গাড়ি থাকে। মোট ৪০০টি গাড়ি এখানে অবস্থান করতে পারে। আর উপরের ২টি ফ্লোর মানুষের জন্যে। এছাড়া আরও উপরে একটি ডেক রয়েছে,যেখানে খোলা অঅকাশের নীচে সমুদ্রের সৌন্দর্য অবলোকন করতে করতে অগ্রসর হওয়া যায়।
ফেরীতে ওঠার আগে টিকেট কাতে হয় এবং টিকেটে লাইন নং দেওয়া হয়,সে অনুযায়ী গাড়িগুলো নির্ধারিত লাইন ধরে রির্দিষ্ট ফ্লোরে প্রবেশ করে। পাশাপাশি মোট ৪৫টি বিশাল লাইনে এখানে সারিবদ্ধ গাড়িসমূহ ফেরীতে প্রবেশ করে। ফেরীর উপরের ফ্লোরে গড়ি প্রবেশের জন্যে ফেরীর উক্ত ফ্লোরের সাথে সংযুক্ত ফ্লাইওভার রয়েছে। এর শেষ মাথাটি স্বয়ংক্রিয় একটি ক্রেনের মত যা উপর-নীচ চলাচল করে ফেরীর সমতলে অবস্থান করে। এর উপর দিয়েই গাড়িসমূহ ফেরীর উপর তলে প্রবেশ করে। পুরো প্রক্রিয়া এতটাই নিষ্ঠার সাথে সম্পন্ন হয় যে কানো রকম হট্টগোল ছাড়াই দ্রত গাড়িসমূহ ফেরীতে নির্ধারিত স্থানে গিয়ে পৌছে। ভেতরে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রনের জন্যে অনেক সংখ্যক সদস্য রয়েছে। এখানে ফেরীঘাটে কয়েকটি সুন্দর ক্যাফে রয়েছে এবং সুভ্যেনিরের দোকান রয়েছে। দেখলাম স্টারবাকস কফি বিক্রী হচ্ছে ব্যপক। পুরুষ ও নারীদের জন্যে চমৎকার টয়লেট রয়েছে। এটিএম বুথ রয়েছে ডলার উত্তোলনের জন্যে কিন্তু আমি ব্যবহার করলে ট্রানজেকশন ফি বাবদ অনেক টাকা কাটবে আবার ডলারের রেট পাব কম। যেহেতু পকেটে যথেষ্ট পাতি আছে,সমস্যা নেই। অবশ্য ফেরীর ভেতরও এটিএম মেশিন আছে কিন্তু সেটাতে ইন্টারন্যাশনাশ ট্রাকজেকশন হয়না। ড্রাইভার বলেছিলো ৪০ মিনিট থাকবে এখানে। আমি হাটাহাটি করলাম। এদিক ওদিক দেখলাম। তারপর একটা চেয়ারে বসে ছিলাম। হঠাৎ ড্রাইভার হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল…এই ফেরী ছেড়ে দিচ্ছে তাড়াতাড়ি …..। দৌড় দিয়ে বাসে উঠলাম। আসলে লোকটা বোধহয় ৩০ মিনিটের অপেক্ষার কথা বলেছিলো কিন্তু তার কথা বুঝতে না পারায় এ সমস্যা। ৩৫নং লাইন ধরে আমরা ফেরীর নীচ তলায় প্রবেশ করলাম। ভেতরে বিশাল জায়গা।
বাস থেকে নেমে ফেরীর লিফটে উঠে ৪তলায় গেলাম। এখানে বিশাল রেস্টুরেন্ট,কফিশপ,গিফট শপ,বাচ্চাদের খেলার স্থান,পোষাকের দোকান,ভিডিও গেমিং জোনসহ অনেক কিছু। আছে শত শত সিটের বসার স্থান। একটা স্থান জুড়ে আছে র্যাপটপ ব্যবহারের স্থান। সেখানে ও আরও অনেক স্থানে মোবাইল,ল্যাপটপ চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। আছে ফ্রি ওয়াইফাই। একই ব্যবস্থা উপরের তলাতেও রয়েছে। আর ফেরীর ফেচনের দিকে একটা বিশেষ রুম আছে যেখানে খুব সুন্দর মনোরম পরিবেশ তৈরী করা হয়েছে। ভেতরে কফিশপ আছে। সুন্দর সুন্দর আরামদায়ক চেয়ার রয়েছে,কাচঘেরা সেস্থান থেকে সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় কোলাহলমুক্ত হয়ে। কিন্তু সেখানে প্রবেশ করতে ১২ ডলার ফি দিতে হয়। ডলারের জন্যে নয়,এমনিতেই সেখানে যাইনি,কারন বাইরেই বেশী মজা। আমি ফেরীর একেবারে উপরের ডেকে গেলাম,খুব সুন্দর। চারিদিকে পানি। সামনে অস্পষ্ট দ্বীপমালা দেখা যাচ্ছে,যার উদ্দেশ্যে যাত্রা। সামনে ক্যাপ্টেনের স্থানের আশপাশেও যাওয়া যায়। চলাচলের জন্যে প্রশস্ত করিযোর রয়েছে। বাইরে বসার জায়গা রয়েছে নেক। বিভিন্ন স্থানে বিভিন্নভাবে বসলাম। দারুন লাগল। ফেরীতে জীবন রক্ষাকারী লাইফ বোট রয়েছে,যা সংকটকালীন সময়ের জন্যে। ফেরীর সকল যাত্রীর জন্যেই ব্যবস্থা রয়েছে। তেলের ব্যারেলের মত সাইজের একেকটি গোটানো লাইফবোট পানিতে পড়েই বিশাল আকারের নৌকায় পরিনত হয় এবং একেকটির ধারন ক্ষমতা ৫০ জন। তবে এরকম বড় ফেরীর ডোবার ইতিহাস কম।
দূরের দ্বীপসমূহ স্পষ্ট হতে লাগল। সবগুলো দ্বীপই অত্যন্ত চমৎকার। সব দ্বীপেই লোকেরা বসবাস করে। ধনীরা এসব দ্বীপে সুন্দর সুন্দর বাড়ি বানায়। কাছ থেকে দ্বীপের চেহারা সত্যিই অসাধারন। ২ ঘন্টা ৪৫ মিনিট পর ভিক্টোরিয়াতে পৌছলাম।
আমি ভেবেছিলাম এটা বোধহয় অনুন্নত কোনো এলাকা হবে হয়ত। কিন্তু দেখলাম এটা অত্যাধুনিক একটি স্থান এবং ধনী মানুষের ছড়াছড়ি। রাস্তায় পোর্শে সহ অনেক দামী দামী গাড়ি। পোর্শের শো-রূমও আছে। মর্সিডিস বেঞ্জ তো অহরহ। বাস এগিয়ে চলল। ড্রাইভারই ড্রাভেল গাইড। ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজীতে বিভিন্ন স্থানের বর্ণনা দিচ্ছিলো আবার সেটা চায়নিজেও বলছিলো। এককালে চায়ানাতে কিছু সময় কাটানোর সুবাদে কিছু চায়নিজ শব্দ শিখেছিলাম যা দিয়ে দু চার কথা বলা যায়। ড্রাইভারের সাথে তা দিয়ে কিছু বাৎচিৎ করাতে ড্রাইভার বেশ পছন্দ করল।
এখানে চায়না টাউন আছে। এরা সুন্দর করে একটা গ্টে তৈরী করেছে ,ড্রাগন তো সেখানে থাকবেই…। এই দ্বীপে জাপনীজরা শত বছরের বেশী সময় ধরে বসবাস করছে। এই দ্বীপটি আকৃতির দিক দিয়ে দুনিয়ার ৮ নং স্থান দখল করেছে। আয়তন ২১৭২৯১ ব:কি:মিটার,যা বাংলাদেশের থেকে দেড় গুনেরও বেশী বড়। উইকিপিডিয়ার ২০১১ সালের তথ্য মতে লোক সংখ্যা মাত্র ৮০০১৭ জন। বর্তমানে লোকসংখ্যা যে এর চেয়ে অনেক বেশী তা এখানে প্রবেশ করলেই বোঝা যায়। দ্বীপে বেশ কিছু বহুতল ভবন রয়েছে। বৃশিশরা ১৮৪৩ সালে এটি শাসন করা শুরু করে। তারা বেশ কিছু চমৎকার বহুতল ভবন নির্মান করে সেসময় ও পরবর্তীতে,যা আজও পর্যটক আকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দু। ইতিহাস গাওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়….।
আসলাম ভিক্টোরিয়ার পার্লামেন্ট বিল্ডিংএ । এ এক সাংঘাতিক সুন্দর বিল্ডিং। দেখলে মনে হবে বিশাল মসজিদ অথবা আব্বাসীয়,উমাইয়া খলিফাদের প্রাসাদ কিন্তু তা না। এখানে বৃটিশরা এক কালে ছড়ি ঘোরাতো। পাশেই আছে এমপ্রেস হোটেল,যেখানে রাজকীয় লোকজন থাকত,মজা করত। এখানে অনেক বিশাল বিশাল ঘোড়ায় টানা গাড়ি রয়েছে। পর্যটকরা তাতে উঠে বিভিন্ন স্থান দর্শন করতে পারে। সময়ের স্বল্পতায় চড়া হয়নি। আশপাশের রাস্তাগুলো মনোরম সুন্দর। এলাকাটা একেবারে ইংল্যান্ডের মত করে সাজানো। পাশেই সাগরের একটি অংশ এসে ঢুকে পড়েছে ভেতরে। সেখানে শত শত বিলাসী নৌযান রয়েছে। সি-প্লেনও আছে। পয়সা দিয়ে টিকেট কেটে তাতে চড়াও যায়। সাগরের এ অংশে তিমি দেখা যায়। মাত্র ৩ ঘন্টার তিমি দেখা ট্যুরও রয়েছে এখানে। তিমি দেখা প্রায় নিশ্চিত এখানে। হাতে সময় নিয়ে আসলে অনেক কিছু দেখার আছে এখানে। প্যাকেজ ট্যুরে মন ভরে উপভোগ করা যায় না,তবে মোটামুটি সবকিছু একটু একটু করে পরখ করা যায়। তাই করলাম। বিশাল এই দ্বীপের সবকিছু অবশ্য দেখার সুযোগ নেই।
এবার একটি পার্কে গেলাম কিন্তু সেটা তেমন সুবিধার নয় বলে বর্ণনা দেবনা। দুপুরে ড্রাইভার নিয়ে গেল চায়নিজ রেস্টুরেন্টে,সেখানে খাবার পছন্দ হলনা। ভিন্ন রেস্টুরেন্টে গিয়ে টুকটাক খেলাম,পছন্দ হলনা। এরপর গেলাম সেউ সুপার জায়হায়। এটা হল বুচার্ট গার্ডেন। এটা জাপানিজদের তৈরী।
অসম্ভব সুন্দর এই গার্ডেন। এখানে কুকুর ঢুকলেও আবেগে মানুষ হয়ে বের হবে। এ যেন ছবি,,,না তার থেকেও বেশী কিছু। এক অসহ্য সৌন্দর্য এখানে খাবি খাচ্ছে। ফুলের বাগান কিন্তু তাই বলে এত সুন্দর !! তাহলে জান্নাত কত সুন্দর। হাজার হাজার রকমের ফুল,গাছ এমনভাবে সাজিয়েছে যে মনে হচ্ছে খেয়ে ফেলি। ঘুস,পুকুর,ঝর্নাধারা তার ভেতর ফুলের গাছ নানান তালে অবস্থান করছে। সুন্দর সব সরু রাস্তা চলে গেছে একে বেঁকে। কখনও সমান্তরাল কখনও উচু নীচু…আহ অসহ্য। পুরো গার্ডেনটি একটি উচু টিলার উপর। এর শেষে এসে তাকালে দূরে সাগরের একটা মুখ শান্ত অবস্থায় দেখা যায়। সত্যিই অসাধারন।
আমার প্রচন্ড ক্ষুধা লাগল কিন্তু এখানে খেলাম না। মনে মনে ভাবছি পাকিস্থানী রেস্টুরেন্টে আজ উলোটপালট খাব। মনে একগাদা ফুর্তি আর পেটে ক্ষুধা নিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম। আরও কিছু বিষয় দেখেছিলাম লিখতে ভালো লাগছে না।
ফেরার পথে ড্রাইভার সকলের কাছ থেকে ৯ ডলার করে সার্ভিস চার্জ নিল নিয়ম বহির্ভূতভাবে। সকলে তা দিল। এটা একেবারেই অন্যায় হল। মনে হয় এটা তার পকেট খরচ। সে অবশ্য বলেছে এটা অফিসে(নিজ পকেট) জমা দিবে……।
ফিরতে রাত হয়ে গেল। আমি গেলাম পাকিস্থানী রেস্টুরেন্টে। গরুর নেহারী অর্ডার করলাম,গরুর শিক কাবাব আর নান রুটি। আশপাশের কিছু বাঙ্গালী চেহারার লোক ক্ষনে ক্ষনে তাকাচ্ছে আর বোধহয় ভাবছে…বাপের জনমে বোধহয় লোকটা কিছু খায়নি……
এসবে পাত্তা দেওয়ার লোক আমি না। ফাকতালে এখানে কর্মরত এক টার্কিশ মেয়ে গল্প জুড়ে দিল। নানান গল্প। বুঝলাম সে তুলনা করছে আমেরিকা কানাডার অর্থনৈতিক অবস্থা। সেই খুচিয়ে খুচিয়ে প্রশ্ন করতে লাগল। বললাম ওরেগনে এরকম গাড়িঘোড়া দেখা যায়না। সে বলল-এটা তো একেবারেই কম, টরেন্টো গেলে তো অবাক হবেন….সেটার তুলনায় এটা কিছুই না।
মনে মনে বললাম অবাক হওয়ার টাইম নেই,এখন ফিরতে পারলে নামাজ পড়ে একটু ঘুম দেব। আবারো হলুদ রঙের সেই সুন্দর আম কিনলাম। এটা খুব দারুন জিনিস। হোটেলে ফিরে মনে হল সফরে আল্লাহ তায়ালা নামাজে কসর করার যে বিধান রেখেছেন তা একমারাত্মক সুপার জিনিস। আহ কত সহজ করেছেন! আল্লাহু আকবার !!
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.