সুভাষ দত্ত। দেশীয় চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি। সেই সঙ্গে একজন দক্ষ অভিনেতা, আঁকিয়ে। বিনয়ী, প্রাণখোলা বরেণ্য এ মানুষটির চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০১২ সালের ১৬ই নভেম্বর তিনি পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। সুভাষ দত্তের জন্ম দিনাজপুরের মামার বাড়িতে। ১৯৩০ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি তার জন্ম। দিনাজপুরে ছিল তার মামার বাড়ি। বাবা-মায়ের বাড়ি ছিল বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে। আঁতুড়ঘর থেকে পরবর্তী শৈশব-কৈশোর কেটেছে তার মামাবাড়িতে। সে অর্থে বাবার বাড়ি ছিল তার কাছে অনেকটাই অচেনা। মূলত লেখাপড়ার জন্যই তাকে মামার বাড়িতে রাখা হয়। সুভাষ দত্তের ডাক নাম পটলা। ভালো নাম সুভাষ চন্দ্র দত্ত। শৈশবে নাটকে অভিনয় এবং নাট্যনির্দেশনা দিলেও সুভাষ দত্তের পেশাগত জীবন শুরু হয় একজন কমার্শিয়াল আর্টিস্ট হিসেবে। ১৯৫৫ সালে সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ দেখে তিনি ছবি নির্মাণে দারুণভাবে আগ্রহী হন। চলতে থাকে প্রস্তুতি। এর মধ্যে এহতেশামের ‘এ দেশ তোমার আমার’ ছবিটিতে প্রথম কমেডিয়ান হিসেবে অভিনয়ের সুযোগ পান তিনি। এরপর কেটে যায় কয়েকটি বছর। ১৯৬২ সালের শেষ দিকে এসে হঠাৎ তার মনে হয় তিনি তো অভিনয় করতে আসেননি। শচীন ভৌমিকের একটি গল্পের চিত্রনাট্য সৈয়দ শামসুল হককে দেখালেন। তিনি বললেন সব ঠিক আছে। এরপর সত্য সাহার সঙ্গে তার কথা হলো। তিনিই চট্টগ্রামের একটি মেয়ের কথা বললেন। নায়িকা নির্বাচিত হলো। ছবিও শেষ। মুক্তি পেলো ‘সুতরাং’ ১৯৬৪ সালের ২৩শে এপ্রিল। ঢাকা, খুলনা, রাজশাহী আর চট্টগ্রামে চারটি প্রিন্ট দিলেন। ছবি সুপারহিট। হিট এ ছবির নায়িকা কবরীও। সুভাষ দত্ত অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো হলো ‘রাজধানীর বুকে’, ‘সূর্যস্নান’, ‘চান্দা’, ‘তালাশ’, ‘নতুন সুর’, ‘রূপবান’, ‘মিলন’, ‘নদী ও নারী’, ‘ভাইয়া’, ‘ফির মিলেঙ্গে হাম দোনো’, ‘ক্যায়সে কাহু’, ‘আখেরি স্টেশন’, ‘সোনার কাজল’, ‘দুই দিগন্ত’, ‘সমাধান’ প্রভৃতি। তার নির্দেশিত ছবিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘সুতরাং’, ‘কাগজের নৌকা’, ‘আয়না’ ও ‘অবশিষ্ট’, ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’, ‘আবির্ভাব’, ‘বলাকা মন’, ‘সবুজ সাথী’, ‘বসুন্ধরা’, ‘সকাল সন্ধ্যা’, ‘ডুমুরের ফুল’, ‘নাজমা’, ‘স্বামী-স্ত্রী’, ‘আবদার’, ‘আগমন’, ‘শর্ত’, ‘সহধর্মিণী’, ‘সোহাগ মিলন’, ‘পালাবদল’, ‘আলিঙ্গন’, ‘বিনিময়’, ‘আকাঙক্ষা’, ‘আমার ছেলে’ ইত্যাদি। তিনি ২০১২ সালের মার্চ মাসে কিউট চ্যানেল আই আয়োজিত চলচ্চিত্র মেলায় আজীবন সম্মাননা লাভ করেন। শিল্পী গড়ার এক মহান কারিগর ছিলেন তিনি। তার হাত ধরেই চলচ্চিত্রে আগমন ঘটে কবরী, সুচন্দা, উজ্জল, শর্মিলী আহমেদ, ইলিয়াস কাঞ্চন, আহমেদ শরীফ ও মন্দিরার। আজীবন সম্মাননা পাওয়ার পর সুভাষ দত্তকে প্রশ্ন করা হয়েছিল কেমন লাগছে আপনার। জবাবে বলেছিলেন, নাহ, তেমন কোন অনুভূতি নেই। অনুভূতি সেই আগের মতো। আজীবন সম্মাননা পেলাম, এটা স্বীকৃতি। ভালো লাগে স্বীকৃতি পেলে। তবে আমার চেয়ে ভালো বলতে পারবেন আমার কাজের যারা ভক্ত, যারা নিয়মিত দর্শক, তারা। আমি কাজ করে গেছি মন দিয়ে। কাজের মূল্যায়ন যারা মূলত করেন তারা হলেন দর্শক। দর্শকের ভালোবাসাই আমার জীবনের অমূল্য সম্পদ। সুভাষ দত্তের প্রবল ইচ্ছা ছিল আরও ভালো ভালো কাজ করার। কিন্তু তার শারীরিক অবস্থা তাকে সেই সাপোর্ট দিতে পারেনি শেষ পর্যন্ত। সুভাষ দত্তের নির্দেশনায় সর্বশেষ ‘ও আমার ছেলে’ ছবিটি নির্মাণ হয়েছে। ছবিটি খুব বেশি ভালো না চললেও এর গল্প নিয়ে তিনি নিজে তৃপ্ত ছিলেন বেশ। ছবিটি প্রসঙ্গে সুভাষ দত্ত বলেছিলেন, এটা সত্য সময় বদলেছে, ছবিতে নানা বিষয়ের চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু তাই বলে যে আদর্শ নিয়ে আমি শুরু থেকে এগিয়ে চলেছি তার বাইরে তো আর যেতে পারি না। সুভাষ দত্তের নির্দেশনায় প্রথম ছবি ছিল ‘সুতরাং’। এ ছবিরই নায়িকা ছিলেন কবরী। কবরী যখন প্রথমবার চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তখন তার ছবিতে সুভাষ দত্তকে অভিনয় করতে বলেন। ছবির নাম ‘আয়না’। ছবিটি ২০০৬ সালে নির্মাণ হয়েছিল। এরপর কোন ছবিতে তাকে কাজ করতে দেখা যায়নি। ১৯৭৭ সালে ‘বসুন্ধরা’ ছবিটির জন্য পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান সুভাষ দত্ত। এরপর ১৯৯৯ সালে একুশে পদকও অর্জন করেন তিনি। এছাড়া দেশ-বিদেশ থেকে অনেক সম্মাননা ও পুরস্কার অর্জন করেন।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.