দেশে বেশ ক’বছর ধরে বিনিয়োগ পরিস্থিতি যে ভালো নয়, এ কথা বিভিন্ন সময় সরকারের পক্ষ থেকেও স্বীকার করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি এবং বিনিয়োগ বোর্ডের নিবন্ধনকৃত পরিসংখ্যান তুলে ধরে দেখানোর চেষ্টা করা হয় দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতি সন্তোষজনক। বাস্তবতা হল, প্রতিশ্রুত এবং বিনিয়োগ বোর্ডে নিবন্ধনকৃত বিনিয়োগের বাস্তবায়ন সংখ্যা খুবই নগণ্য- ১০ শতাংশেরও কম। প্রতি বছর দেশে যে পরিমাণ বিনিয়োগের তথ্য দেয়া হয় তা মূলত প্রতিশ্রুতিতেই সীমাবদ্ধ থাকে। এ সত্য বেরিয়ে এসেছে যুগান্তরের অনুসন্ধানে। দেখা গেছে, ২০১৫ সালে বিনিয়োগ বোর্ডে যেসব প্রতিষ্ঠান নিবন্ধিত হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব দিয়েছিল এমএএফ পেট্রোকেমিক্যাল নামে একটি কোম্পানি। দেশের পেট্রোকেমিক্যাল খাতে প্রতিষ্ঠানটির ১১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করার কথা। কিন্তু এক বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এ পর্যন্ত এর কোনো অগ্রগতি জানে না বিনিয়োগ বোর্ড। বস্তুত বিনিয়োগ বোর্ড শুধু নিবন্ধনের কাজ করে। কী পরিবাণ বাস্তবায়ন হয় সেই হিসাব তাদের কাছে নেই। ফলে বিনিয়োগের সরকারি তথ্যে থেকে যায় শুভঙ্করের ফাঁকি।
প্রায় একই ব্যাপার ঘটছে রফতানি আয়ের হিসাবের ক্ষেত্রে। দেশের প্রধান রফতানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পের বড় সাফল্যের যে হিসাব, তা রয়েছে কেবল কাগজে-কলমে, যার সঙ্গে প্রকৃত রফতানি আয়ের কোনো মিল নেই। উদাহরণস্বরূপ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমএ, বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআর থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় ২০১১-১২ থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে পোশাক রফতানি হয়েছে ১১ হাজার ৮৬৮ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের। এই পোশাক রফতানির উপযোগী করতে কাঁচামাল আমদানিতেই খরচ হয়েছে ৭ হাজার ৫২৬ কোটি ডলার। এছাড়া দক্ষ জনশক্তি আমদানিসহ অন্যান্য খাতে অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৫০০ কোটি ডলার। ফলে এ সময়ে তৈরি পোশাক রফতানি থেকে নিট আয় দাঁড়ায় ১ হাজার ৮৪২ কোটি ডলার। অর্থাৎ রফতানি আয়ের তথ্যেও রয়েছে এক ধরনের শুভঙ্করের ফাঁকি।
দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতিতে স্থবিরতা বিরাজ করছে এটিই বাস্তবতা। এ ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে হবে। উদ্যোক্তারা ইতিপূর্বে বেসরকারি খাতের বিকাশ ও শিল্পায়নের স্বার্থে প্রয়োজনে স্বল্প সুদের ‘টেকসই উন্নয়ন ফান্ড’ গঠনের পরামর্শ দিয়ে শিল্প খাতে গ্যাস, বিদ্যুৎসহ অন্যান্য সেবা নিশ্চিতকরণ, কর্পোরেট ট্যাক্স হ্রাস ও প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধির তাগিদ দিয়েছেন। বিনিয়োগে গতি আনতে হলে এসব পরামর্শ দ্রুত কার্যকর করা উচিত বলে আমরা মনে করি। দুঃখজনক হলেও সত্য, সরকার বিদেশী বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রে আইন-কানুন শিথিলসহ বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদানে যতটা উদারতার পরিচয় দেয়, দেশীয় উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে ততটা নয়। উদ্যোক্তারা নতুন কোনো শিল্প গড়তে গিয়ে পদে পদে হয়রানি ও বিড়ম্বনার শিকার হন এবং এক পর্যায়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এ অবস্থার অবসান হওয়া উচিত। একইভাবে নিতে হবে প্রকৃত রফতানি আয় বাড়ানোর উদ্যোগ। এ উদ্দেশ্যে কাঁচামাল আমদানিনির্ভরতা কমাতে দেশে পশ্চাৎশিল্পের বিকাশ ঘটাতে হবে। গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট, ব্যাংক ঋণের চড়া সুদ, উচ্চ সার্ভিস চার্জ, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ইত্যাদি এ শিল্প বিকাশের বড় বাধা। এসব বাধা অপসারণে নিতে হবে পদক্ষেপ। বিনিয়োগ ও প্রকৃত রফতানি আয় বৃদ্ধি পেলে দেশে নতুন নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থানের সুযোগ। নীতিনির্ধারকরা এটা যত দ্রুত অনুধাবন করবেন ততই মঙ্গল।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.