দুপুর গড়িয়ে বিকেলের সূর্যটা লাল হওয়ার অপেক্ষায়। বাস থামতেই দ্রুত নেমে রিকশা ডাকলাম। ‘মামা, কোথায় যাবেন?’ রিকশাওয়ালা জিজ্ঞেস করলেন। ‘নদীর ঘাটে যাব, মেঘনা নদী।’ ভাড়া জিজ্ঞেস না করেই রিকশায় চেপে বসলাম। যেতে যেতে রিকশাওয়ালা জামালউদ্দিন বললেন, ‘এইখানে শুধু মেঘনা নদী না আরও দুইটা নদী আছে। পদ্মা আর ডাকাতিয়া নদী। তিনডা তিন দিক থেইক্কা কোড়ালিয়ার মুখে আইসা মিলছে। এ জন্যই এইখানে এত ইলিশ মাছ আসে!’ দেখতে দেখতে আমাদের রিকশা চাঁদপুর বড় স্টেশনে এসে থামল। বিকেলের সূর্যাস্ত দেখতে শত শত মানুষের ভিড়। সূর্যাস্তের সঙ্গে খাঁজকাটা মেঘের মিতালি সৃষ্টি করেছে অসাধারণ এক সৌন্দর্যের। চাঁদপুরের বড় স্টেশনের বিকেলের এই গোধূলিবেলা হার মানাবে অনেক সমুদ্রসৈকতের সৌন্দর্যকেও। দূরে দেখা যাচ্ছে চর রাজরাজেশ্বর। নৌকা আর ট্রলারে চড়ে মানুষ ছুটে যাচ্ছে সেখানে। চাঁদপুর বড় স্টেশন থেকে রাজরাজেশ্বর চরে যেতে সময় লাগে ৩০ মিনিট। নদীতে নৌকায় করে ঘুরে বেড়ানো আর রাজরাজেশ্বরের বালুচরে হেঁটে চলা যেন সমুদ্রসৈকতের তৃপ্তি এনে দেয়। পদ্মা ও মেঘনার মিলনস্থলে আছে আরেক তাক লাগানো সৌন্দর্যের উৎ স। দুটি নদী—মেঘনা ও পদ্মা সমানতালে পিঠাপিঠি বয়ে চলছে অথচ কেউ কারও সঙ্গে মিশছে না। ঘোলা সাদা পানি আর স্বচ্ছ কালো পানির এই নিরবচ্ছিন্ন বয়ে যাওয়ার দৃশ্য যে কারও মন ছুঁয়ে যাবে। ব্রিটিশ শাসনামলে চাঁদপুর ছিল তৎ কালীন পূর্বভারতীয় উপমহাদেশের প্রবেশদ্বার। এ জেলা তখন থেকেই বেশ সমৃদ্ধশালী। তবে যেটির জন্য সমৃদ্ধশালী সেটি আর অন্য কিছু নয়, আমাদের জাতীয় মাছ ইলিশ। ইলিশের জন্য এখনো চাঁদপুর তার সুদীর্ঘ ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। এই ইলিশের জন্যই চাঁদপুরে গড়ে উঠেছে তিন ধরনের যোগাযোগব্যবস্থা। অনায়াসে একে ‘ইলিশপুর’-ও বলা যায়। সূর্য ডোবার পরপরই ইলশাঘাটে গেলাম ইলিশ দেখতে। চারদিকে ইলিশ আর ইলিশ। নৌকা থেকে জেলেরা বড় বড় খাঁচা ভরে ইলিশ নামাচ্ছে ঘাটে। আর ক্রেতারা হুমড়ি খেয়ে পড়ছে তাদের পছন্দের ইলিশ কিনতে। ক্রেতা-বিক্রেতায় পরিপূর্ণ ইলশাঘাট। ইলিশের পাশাপাশি গলদা চিংড়ি, বোয়াল ও চিতল মাছও চোখে পড়ল। নিজেও দরদাম করলাম। দুই কেজি ওজনের একটা ইলিশ কিনেও ফেললাম। ইলিশ মাছ বড় হলে একটু লালচে রঙের হয়। এটাও ঠিক সে রকম দেখাচ্ছে। কিন্তু তাজা ইলিশ বাড়ি নিয়ে কেটেকুটে রান্না করার পর এর স্বাদ নেওয়া যাবে, এতটা সময় অপেক্ষা করতে ইচ্ছে করছিল না। খোঁজ পেলাম মনু মিয়ার দোকানের। সেখানে সদ্য নদী থেকে ধরে আনা ইলিশ মাছ ভেজে বিক্রি করা হয়। ঘাট থেকে হেঁটে যেতে পাঁচ মিনিট লাগল। দোকানের কাছাকাছি যেতেই ইলিশের ঘ্রাণে অর্ধভোজন হয়ে গেল। শুধু ভাজা ইলিশই নয়, ইলিশের ডিমও বিক্রি হয় এখানে! যেভাবে যাবেন ঢাকা থেকে লঞ্চে চাঁদপুর যেতে সময় লাগে চার ঘণ্টা। দিনে দিনেও ঢাকা থেকে চাঁদপুর বেড়িয়ে আসা যায়। আবার আসা-যাওয়ার দুই রাতই কাটিয়ে দেওয়া যায় লঞ্চে। যেমন ঢাকা সদরঘাট থেকে রাত ১২টার লঞ্চে রওনা দিলে সকালবেলা চাঁদপুরে পৌঁছাবেন। সারা দিন কাটিয়ে আবার রাত ১২টার লঞ্চে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হওয়া যাবে। এতে চাঁদপুরে গিয়ে কোনো হোটেল ভাড়া করার প্রয়োজন হবে না। আর যদি জ্যোৎ স্না রাত হয় তাহলে তো কোনো কথাই নেই। চাঁদপুরে মানসম্মত হোটেল রয়েছে বেশ কয়েকটি। যেকোনো লঞ্চে প্রত্যেক যাত্রীর জন্য সর্বনিম্ন ভাড়া ১০০ টাকা। কেবিন ৫০০ থেকে শুরু করে ৮০০ টাকা পর্যন্তও রয়েছে। যে লঞ্চগুলো ঢাকা-চাঁদপুর পথে যাতায়াত করে, সেগুলোর মধ্যে রফরফ, প্রিন্স রাসেল, ঈগল, আল বোরাক, তুতুল, বোগদাদিয়া, ময়ূর, সোনার তরী ও মেঘনা রানী অন্যতম। এ ছাড়া বাস ও ট্রেনেও চাঁদপুরে যাওয়া যায়।