গত শুক্রবার ছিল আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস। এ দিনের এক আলোচনা সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন দেশবাসীর সামনে যে তথ্য তুলে ধরেছেন, তাতে বিস্মিত হয়েছেন অনেকে। তিনি বলেছেন, ২০০৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এক দশকে বাংলাদেশ থেকে ৪ লাখ ৫৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে, যার মধ্যে ২০১৩ সালেই পাচার হয়েছে ৭৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। টাকা পাচার বিষয়ে সিপিডি’র ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য দিয়েছেন আরেক চাঞ্চল্যকর তথ্য। বলেছেন, ২০১৪ সালে পাচার হয়েছে ৯০০ কোটি ডলার অথচ বছরে আমাদের বৈদেশিক সাহায্য আসে ১০০ কোটি ডলার। অদ্ভুত ঘটনাই বটে। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের অভ্যন্তরে বিনিয়োগ পরিবেশের অভাব ও আর্থিক নিরাপত্তাহীনতাই টাকা পাচারের দুই প্রধান কারণ। এ দুই কারণের সঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সাংঘর্ষিক রাজনীতিও টাকা পাচারের পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে কাজ করছে। দেখা যাচ্ছে, নির্বাচনের প্রাক্কালে টাকা পাচারের প্রবণতা বেড়ে যায়, কারণ অনেকেই মনে করেন নির্বাচনের ফলাফলের ওপর তাদের অর্থ ও সম্পদের ভাগ্য অনেকটা নির্ভর করে। আবার বিনিয়োগের সুযোগ না থাকায় অনেকে বৈধ টাকাও বিদেশে নিয়ে যাচ্ছেন। মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমসহ কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে বিনিয়োগ করে দেশগুলোর নাগরিকত্ব অর্জনের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন অনেকে। এক কথায় বললে, টাকা পাচারের এক হিড়িক লেগেছে। আর এ ধারা অব্যাহত থাকলে যে এক সময় দেশ অর্থনৈতিকভাবে মরণদশায় পড়বে, তা ব্যাখ্যা না করলেও চলে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক যথার্থই বলেছেন, সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছে বলেই দেশ থেকে বিপুলাকার অর্থ পাচার হচ্ছে। টাকা পাচার হয় মূলত আন্ডার ইনভয়েস ও ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে। এ ছাড়া হুন্ডি ও অন্যান্য মাধ্যমেও পাচার হয়। টাকা পাচার রোধ করা কি খুব কঠিন কাজ? বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, দুদক ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান সজাগ থাকলেই টাকা পাচার প্রক্রিয়া অন্তত সহনীয় মাত্রায় আনা সম্ভব। অথচ একটি গণতান্ত্রিক সরকারের অধীনে এত এত নজরদারি প্রতিষ্ঠান থাকতেও পাচার হয়ে যাচ্ছে টাকা! কেন দায়িত্বে এই অবহেলা, এই উদাসীনতা?
টাকা পাচার রোধ করতে হলে দেশে অবাধ বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। কয়েকদিন আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পাঁচটি বড় বাধা রয়েছে। এই বাধাগুলো অপসারণ করতে হবে অবশ্যই। বুঝতে হবে একশ্রেণীর লোক বাধ্য হয়েই পাচার করে টাকা। তাদের মধ্যে দেশপ্রেমের ঘাটতি নেই; কিন্তু আর্থিক নিরাপত্তাহীনতার কথা ভেবে তারা টাকা পাচারে উৎসাহী হয়। মানুষকে শুধু মুখে দেশপ্রেমিক হওয়ার উপদেশ দিয়ে লাভ নেই। দেশপ্রেম আসলে জাগ্রত করতে হয় এবং তা এমনভাবে যাতে মানুষ রাষ্ট্রের প্রতি তার সম্পৃক্ততা উপলব্ধি করতে পারে। দ্বিতীয়ত, টাকা পাচার রোধে বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর ও দুদককে তাদের নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করতে হবে যথাযথভাবে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সক্ষমতাও বাড়াতে হবে। মনে রাখা দরকার, যারা টাকা পাচার করে তারা সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তি। আইন এড়িয়ে চলার সুবিধা ভোগ করে থাকেন তারা। সুতরাং তাদের প্রভাব ও শক্তিকে দমন করতে হবে অধিকতর শক্তি দিয়ে। টাকা পাচার ও পাচারপ্রবণতা বন্ধ করতে হবে যে কোনো উপায়েই।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.