পদ্মার বুকে ঘুরে বেড়ানো রবীন্দ্রনাথের বজরা নৌকার কথা মনে পড়ে গেল নীলকৌড়িতে পা দিতেই। নীলকৌিড় যেন এর আধুনিক সংস্করণ। আরামদায়ক বিছানা, বড় পর্দার এলইডি টেলিভিশন, শীতাতপনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা—একটি বিলাসী হোটেলে যা যা থাকে, তার সবই আছে এখানে। আছে শোবার ঘর ও ড্রয়িং কর্নার। শোবার ঘরের জানালা খুললে খণ্ড খণ্ড দৃশ্যচিত্রের মতো সরে যাওয়া কাপ্তাই হ্রদ আর তীরের পাহাড়। ডেকে পাতা বেতের চেয়ারে বসে নতুন করে চিরচেনা কাপ্তাই হ্রদকে নতুন করে আবিষ্কারের সুযোগ মিলল।
৫০ বাই ২০ ফুটের বোট হাউসে চড়ে কাপ্তাই হ্রদের এমন শান্ত-সমাহিত দৃশ্য দেখার অভিজ্ঞতা এই প্রথম। জানা গেল, দৃষ্টিনন্দন এই নৌযানের নকশাকার তরুণ স্থপতি আদর ইউসুফ। ছোট এই বজরাটি এখন কাপ্তাই হ্রদের বাঁধের ধার ঘেঁষে গড়ে ওঠা ‘লেকভিউ আইল্যান্ড’ রিসোর্টের অন্যতম আকর্ষণে পরিণত হয়েছে।
রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলায় কাপ্তাই বাঁধের কাছেই সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে গড়ে উঠেছে লেকভিউ আইল্যান্ড নামের এই রিসোর্ট। কাপ্তাই হ্রদের দুই তীরজুড়ে এই রিসোর্টে আছে দুটি অবকাশযাপনকেন্দ্র। একটির নাম হিলটপ, অন্যটির নামকরণ করা হয়েছে রিসোর্টেরই নামে—লেকভিউ আইল্যান্ড।
চট্টগ্রাম থেকে সোয়া দুই ঘণ্টায় কাপ্তাই এসে পৌঁছাতেই আমাদের স্বাগত জানাল বন, পাহাড় ও নয়নাভিরাম হ্রদ। এত দিন কাপ্তাই হ্রদের বাঁধ এলাকায় সাধারণের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। এবার সেই বাঁধের সরু সড়ক ধরেই আমরা এসে পৌঁছাই হিলটপ অবকাশকেন্দ্রে। রিসোর্টের চারদিকে বড় বড় গাছপালা। থেকে থেকে বিরামহীনভাবে ডেকে যাচ্ছে কোনো পাখি। এখানকার ‘সিন্ধু সারস’ নামের রেস্তোরাঁর পাশেই রয়েছে একটা ছোটখাটো ‘ইনফিনিটি’ সুইমিং পুল। পাহাড়ের উঁচুতে হলেও পুলে নামলে মনে হবে আপনি হ্রদের জলেই সাঁতার কাটছেন। পুলের এক দিকে পাতা চেয়ারে বসে উপভোগ করা যায় হ্রদের অপরূপ দৃশ্য। ‘সিন্ধু সারসে’ ২৫ জন অতিথি একসঙ্গে বসতে পারেন। চাইলে দিনব্যাপী সভা ও বৈঠকের জন্য ভাড়াও করা যায়। এই অবকাশকেন্দ্রের ‘অধরা’ ও ‘গাঙচিল’ নামের দুটি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত (এসি) কটেজে রাত কাটানোর ব্যবস্থা রয়েছে। কাপ্তাই হ্রদমুখী করে তৈরি গাঙচিলে একবার ঢুকলে আর বের হতে ইচ্ছে করে না। এই কটেজের দুটি কক্ষে দুটি পরিবারের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। কটেজের বারান্দায় বসে কাপ্তাই হ্রদের দৃশ্য দেখে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটানো গেল। তবে শুধু বসে থাকলে হবে কেন। হ্রদের অপর পাড়ে লেকভিউ আইল্যান্ডে বেড়ানোর জন্য সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলাম রিসোর্টের ঘাটে। সেখান থেকে রিসোর্টের বোটে চড়ে মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছালাম ‘লেকভিউ আইল্যান্ডে’।
চার একর জায়গাজুড়ে অবস্থিত লেকভিউ আইল্যান্ড যেন একটি ছোটখাটো দ্বীপ। রিসোর্টের শুরুতেই কাচে ঘেরা ‘গ্লাস হাউসে’ বসে হ্রদের সৌন্দর্য দেখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে সোফায় গা এলিয়ে দিলে কেবলই প্রশান্তি। হ্রদের বুক চিরে চলে যাওয়া ছোট ছোট নৌযান আর পাহাড়ের সারি দেখতে দেখতে মন ভালো হয়ে যায়। ‘ইয়েলো’ আর ‘অরেঞ্জ’ নামের দুটি জোনে ভাগ করা হয়েছে এই রিসোর্টকে। ইয়েলো জোনে রয়েছে ‘কর্ণফুলী’ ও ‘রাইখিয়াং’ নামের দুটি এসি এবং ‘হরিণা’ ও ‘মাইনি’ নামের আরও দুটি নন–এসি কক্ষ।
সারা দিন হ্রদে ঘোরাঘুরি করে বিকেলে যাতে পর্যটকদের ভালো সময় কাটে, এ জন্য এখানে রয়েছে ‘অরেঞ্জ জোন’ নামের বিনোদনকেন্দ্র। এখানে হ্রদের একটি খাড়ির ভেতর ভাসছিল প্রমোদতরি ‘নীলকৌড়ি’। তার ডেকে বসে থাকা পর্যটকদের কেউ কেউ চোখে দুরবিন লাগিয়ে প্রকৃতি দেখায় ব্যস্ত। পাশে ছোট টিলার ওপর শিশুদের নানা রাইডসহ কিডস কর্নার ও ‘ট্রি হাউস’ রয়েছে। ট্রি হাউসের বড় পাটাতনে বসে আশপাশের পাহাড়ের দৃশ্য ও হ্রদ দেখা যাবে। আর এই ট্রি হাউসে আসতে হবে ঝুলন্ত সেতু দিয়ে। ঝুলন্ত সেতুর কিছু অংশ আবার কাচ দিয়ে তৈরি, যাতে নিচের দিকে তাকালে উচ্চতার বিষয়টা বোঝা যায়।
বড়শি দিয়ে মাছ ধরার জন্য অরেঞ্জ জোনের এক প্রান্তে বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়া চাইলে দ্রুতগতির স্পিডবোটেও ঘুরে বেড়ানো যায়। যাঁরা বেশি অ্যাডভেঞ্চার–প্রিয়, তাঁদের জন্য তাঁবুতে রাত কাটানোর সুযোগও আছে এখানে। এ ছাড়া যাঁরা ট্রেকিং করতে চান, তাঁরা প্রশিক্ষিত গাইডের তত্ত্বাবধানে পাহাড়ি পথে ঘুরেও আসতে পারেন।
চট্টগ্রাম থেকে ৫৮ কিলোমিটার দূরে কাপ্তাই যেতে হলে বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল থেকে বাসে উঠতে হবে। সময় লাগবে দুই ঘণ্টা থেকে সোয়া দুই ঘণ্টা। লেকভিউ আইল্যান্ড রিসোর্টে যাওয়ার জন্য কাপ্তাই বাঁধের সংরক্ষিত এলাকার সামনে নামতে হবে। এরপর সেখান থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে হিলটপ অবকাশকেন্দ্রে যেতে সময় লাগবে ১০ মিনিট।
কোথায় কত খরচ: হিলটপ অবকাশকেন্দ্রের এসি কটেজ গাঙচিলের প্রতিটি কক্ষের ভাড়া চার হাজার আর অধরা কটেজের ভাড়া তিন হাজার টাকা। লেকভিউ আইল্যান্ডের এসি কটেজ কর্ণফুলী ও রাইখিয়াংয়ের ভাড়া চার হাজার করে। এ ছাড়া নন–এসি হরিণা ও মাইনির ভাড়া দুই হাজার টাকা।
লেকভিউ আইল্যান্ডে বনভোজনেও আসা যায়। ৫০ জনের জন্য পিকনিক স্পটের ভাড়া বন্ধের দিন ১৫ হাজার টাকা। আর অন্যান্য দিন ১০ হাজার টাকা। নীলকৌড়ির প্রমোদতরির এক রাতের ভাড়া ১০ হাজার টাকা। এর মধ্যে এক ঘণ্টা হ্রদের বুকে ক্রুজিং ফ্রি। চাইলে প্রতি ঘণ্টা তিন হাজার টাকায়ও ভাড়া নেওয়া যায় নীলকৌড়ি। এ ছাড়া স্পিডবোট নিয়ে লেকের এক কিলোমিটার এলাকা ঘুরে আসতে খরচ হবে ২০০ টাকা। কটেজে না থেকে তাঁবুতে রাতযাপন করতে চাইলে দুজনের জন্য ভাড়া গুনতে হবে এক হাজার টাকা। আর বড়শি দিয়ে মাছ ধরা যাবে ৫০০ টাকার বিনিময়ে।
বুকিং: ফেসবুকে ‘লেকভিউ আইল্যান্ড’ নামে একটি অফিশিয়াল পেজ আছে। সেখানে থাকা মোবাইল নম্বরে কথা বলেই সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় বুকিং দেওয়া যাবে। তবে ফোনে বুকিং দিতে হলে ০১৭৬৯-৩২২১৮২, ০১৭৬৯-৩২২১৮৩ ও ০১৮৪৭-১৯১৪২১ নম্বরে যোগাযোগ করতে হবে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.