সঞ্জয় সরকার : বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী। কিন্তু উৎসবের দিন মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ’। কবিগুরু যথার্থই বলেছেন। উপলক্ষ যাই হোক না কেন, বাঙালির সকল উৎসবের মধ্যে একটা সর্বজনীন রূপ আছে। এতে ধর্ম, সম্প্রদায়, জাত-পাত বা ধনী-গরিবের সামাজিক বিভক্তি বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। বরং সকল শ্রেণির মধ্যে সেতুবন্ধন রচিত হয়। আর এ কারণেই কালের বিবর্তনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকতার ধরন পাল্টালেও আবহমান বাংলার সামাজিক উৎসব, পার্বণ বা গণমানুষের মেলবন্ধনের ঐতিহ্য-কৃষ্টিগুলো আজও হারিয়ে যায়নি। মেলা মানেই মহামিলন। মানুষের উচ্ছ্বাস-উল্লাসের বহিঃপ্রকাশ ঘটে মেলার মধ্য দিয়ে। ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের উর্ধে উঠে মেলা মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন গড়ে দেয়। গ্রাম-বাংলার মেলা তাই হাজার বছরের ঐতিহ্যের এক মহা সম্মিলন।
কবে, কোথায়, কখন প্রথম মেলার প্রচলন হয়েছিল তা জানা না গেলেও এটি যে আবহমান বাংলার এক প্রাচীণ ঐতিহ্য এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। ধারণা করা হয়, গ্রামীণ হাট থেকেই আসে মেলার ধারণা। অতীতে রাজা-জমিদারেরা মেলার আয়োজন বা পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। ধর্মীয় কোনো উপলক্ষে মেলা বসত। তাই বাংলার বারো মাসের তেরো পার্বণের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে মেলা।বৈশাখ থেকে চৈত্র প্রতি মাসেই মেলা অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। এক সময় পীর-ফকির বা সাধু-সন্যাসীদের আস্তানাগুলোও মেলার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। ধর্মীয় চেতনার বাইরে অন্যান্য সামাজিক বা লৌকিক আচারগুলোও যুক্ত হতে থাকে মেলার সঙ্গে।
বাংলাদেশের এমন কোন জেলা বা উপজেলা নেই যেখানে মেলার আয়োজন করা হয় না। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) গ্রামীণ মেলার ওপর দেশজুড়ে এক জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করে ১৯৮৩ সালে। ১ হাজার ৫টি মেলার সন্ধান পাওয়া যায় ওই জরিপে। জরিপ কার্যক্রমটি আরও পঞ্চাশ-একশ বছর আগে পরিচালিত হলে মেলার সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি হতো। বিসিকের প্রাপ্ত সংখ্যার নব্বইভাগ মেলাই গ্রামীণ। সারা বছরই দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভিন্ন ভিন্ন নামে এসব মেলা বসে। কখনও বট-পাঁকুড়ের ছায়ায়, নদীর পাড়ে, আবার কখনও মন্দির-মঠ-তীর্থস্থানে বা সাধু-সন্যাসী-পীর-ফকিরদের আস্তানায় এবং গ্রামের খোলা মাঠে বসে এসব গ্রামীণ মেলা।
এখনও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যেসব মেলার আয়োজন হয় এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ধামরাইয়ে রথের মেলা, মজমপুরের মেলা, নবাবগঞ্জের ধাইনগর মেলা, চরখাই কাটলা মেলা, চট্টগ্রামের চন্দ্রনাথ মন্দিরের মেলা, মাইজভান্ডারির মেলা, পটিয়ার ঠেগড়মুনির মেলা, জব্বারের বলি খেলার মেলা, বগুড়ার মহাস্থান গড়ের মেলা, পোড়াদহের সন্ন্যাস মেলা, গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দির মেলা, পাবনার বোঁথরের চড়ক মেলা, হবিগঞ্জের মুড়াবন্দ দরবার শরীফের মেলা, টাঙ্গাইলের ধনবাড়ির মেলা, ফাইলা পাগলার মাজারের মেলা, রাঙামাটির পানছড়ি বৌদ্ধ মেলা, দিনাজপুরের নেকমর্দন মেলা, কুমিল্লার শীতলার মেলা, সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জের বারুনী মেলা, নরসিংদীর শাহরানীর মেলা, শরীয়তপুরের সুরেশ্বর মেলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাতমোড়ার মেলা, যশোরের মধুমেলা, পঞ্চগড়ের নিরাশির মেলা, বরিশালের বিপিনচাঁদ ঠাকুরের মেলা, তাড়াইলের মাঘী পূর্ণিমার মেলা, কমিল্লার চৌদ্দগ্রামের বাতিসার মেলা, মুন্সীগঞ্জের ভাগ্যকূল মেলা, বিক্রমপুরের রামপালের মেলা, রংপুরের সিন্দুরমতি মেলা, নেত্রকোনার চন্ডীগড় মেলা, পিরোজপুরের খারবাক মেলা, খুলনার মোল্লার হাট মেলা, বাগেরহাটের খানজাহান আলীর মেলা, কুষ্টিয়ার মহরম মেলা, ছেঁউড়িয়ার লালন মেলা, নড়াইলের সুলতান মেলা ইত্যাদি।
মেলা সামনে রেখে চারু, কারু ও অন্যান্য কুটির শিল্পীরা দীর্ঘ সময় নিয়ে প্রস্তুতি নেয়। কামার, কুমার, ও বাঁশ-বেতের শিল্পীরা নিপুণ হাতে তৈরি করে বিভিন্ন সামগ্রী। শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সের মানুষের আকর্ষণ থাকে মেলায়। গ্রাম-বাংলার অনেকে মেলা থেকেই পুরো বছরের ঘর গেরস্থালির তৈজসপত্র কিনে থাকেন। ফলে মেলা উপলক্ষে গ্রাহকদেরও প্রস্তুতি থাকে। অভাব-অনটন যতই থাকুক, মেলার জন্য সকলেরই ছোটখাটো বাজেট থাকে। মেলার আগে বড়রা শিশুদের নগদ টাকা বকশিশ দেন। অঞ্চল বিশেষে এ ধরনের উপহারকে বলা হয় ‘মেলার পড়বি’।
বাহারি পণ্যের পসরা বসে মেলায়। শিশুদের আনন্দ-বিনোদনের জন্য মেলায় পাওয়া যায় মাটির পুতুল, পালকি, ঘোড়া, ষাঁড়, হরিণ, হরেক রকমের ঘুড়ি, টমটম, লাটিম, গাড়ি, বল, বেলুন, বাঁশিসহ নানান রকমের খেলনা। গাঁয়ের বধূ ও কিশোরীরা মেলা থেকে কিনে নেন আলতা, স্নো, পাউডার, কাঁচের চুড়ি, নাকের নোলক, কানের দুল, চুলের ফিতা, খোপা, ক্লিপসহ দেহাবরণের জিনিসপত্র। হিন্দু রমণীরা মেলা থেকে ফিরে একে অপরকে জলেভাসা সাবান ও সিঁদুর উপহার দিয়ে শুভ কামনা জানান। এ ছাড়া গেরস্থালির জিনিসপত্র যেমন দা, কাঁচি, কুড়াল, খুন্তি, রান্না-বান্নার সরঞ্জাম, পাখা, চালনি, জলচৌকি, পিঁড়ি থেকে শুরু করে বৃদ্ধদের ছড়িও পাওয়া যায় মেলায়। থাকে রসনা তৃপ্তির জিনিসপত্রও। বিশেষ করে মেলা থেকে কেনা জিলাপি, গজা, রসগোল্লা, কদমা, বাতাসা, বিন্নি ধানের খৈ ও দই-চিড়ার স্বাদই যেন আলাদা। কাপড়, মনোহারি, প্লাস্টিক পণ্য, পূজার জিনিসপত্র, ধর্মীয় পোস্টার, ছবি, বাঁশ-বেতের সামগ্রী, তামা-কাঁসা-পিতলের বাসনপত্র প্রভৃতির দোকানও বসে মেলায়।
মেলায় দর্শকদের তাৎক্ষণিক মনোরঞ্জনের জন্যও থাকে নানান আয়োজন। নাগরদোলা, লাঠিখেলা, কুস্তিখেলা, পুতুল নাচ, যাত্রাগান, কবিগান, বাউল গান, ঘেটু গান, জারি গান, গাজীর গান, পীর-ফকিরদের গান, বায়স্কোপ, সং, সার্কাস, লটারি, কীর্ত্তন, নৌকা বাইচ, ষাঁড়ের লড়াই প্রভৃতি আয়োজন দর্শকদের বাড়তি আনন্দের খোরাক যোগায়। অষ্টমী, বারুনী বা বিভিন্ন পূণ্যস্থানের মেলাকে বাংলার মানুষ ধর্মীয় উৎসব বলেই মনে করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য মেলার নামে অনেক জায়গায় জুয়া-হাউজি-অশ্লীল নৃত্যসহ কিছু অপ-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড হয়। এগুলো মেলার মূল সংস্কৃতি নয়। মূলত এর পেছনে থাকে অর্থলিপ্সা। মেলায় হাজারো মানুষের স্রোত পূঁজি করে এক শ্রেণির লোক এ ধরনের বেআইনি উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার চেষ্টা করে। এতে মেলার পরিবেশ শ্রীহীন হয়। তবে সর্বসাধারণ কখনও এ বিষয়গুলোকে মেলার আঙ্গিক হিসাবে মনে করেন না। তারা মেলাকে ধর্মীয় উৎসব, লোকাচার, আনন্দ-বিনোদন বা বছরের কোনো একটি বিশেষ দিন হিসেবেই বিবেচনা করে।
বাংলাদেশ ‘মেলার দেশ’ হলেও গ্রামীণ মেলার সেই জৌলুস দিন দিন কমে আসছে। কমছে মেলার সংখ্যাও। আগে গ্রামাঞ্চলে বা বিভিন্ন তীর্থস্থানে আয়োজক কমিটির ব্যবস্থাপনায় যেভাবে মেলার আয়োজন হতো এখন তা অনেক ক্ষেত্রেই আর দেখা যায় না। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু দায়িত্ব পালন ছাড়া সরকারিভাবে গ্রামীণ মেলায় তেমন কোনো পৃষ্ঠপোষকতাও করা হয় না বললেই চলে। তবে কিছুটা সুখবর হচ্ছে গ্রামীণ মেলার কনসেপ্টকে ধারণ করে এখন অনেক আধুনিক জিনিসপত্রেরও মেলা বসে। বিভিন্ন মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতায় এ ধরনের আয়োজনগুলো হয় সাধারণত শহরাঞ্চলে। যেমন মোবাইল মেলা, কম্পিউটার মেলা, আইটি মেলা, আবাসন মেলা ইত্যাদি। আবার সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বিজ্ঞান মেলা, বাণিজ্য মেলা, শিল্প মেলা, বই মেলা, কৃষি মেলা, স্বাধীনতা মেলা প্রভৃতি মেলার আয়োজন করা হয়। আয়োজন যারাই করুক আর যেভাবেই হোক, মেলা যুগ যুগ ধরে মানুষের মাঝে মেলবন্ধন তৈরি করে। নানান ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের মধ্যে রচনা করে সেতুবন্ধন। তাই মেলা বেঁচে থাকুক চিরদিন।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.