শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড আর শিক্ষকরা জাতি তথা মানুষ গড়ার কারিগর। অথচ আজীবন মানুষ গড়ার পেছনে শ্রম দিয়ে শেষ জীবনে এসে সর্বশেষ সম্বলটুকু পাওয়ার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হচ্ছে শিক্ষক ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের। যেখানে অবসর জীবন হাসি-আনন্দে কাটানোর কথা, সেখানে নিজেদের আজীবনের সঞ্চয় অবসর ও কল্যাণ ভাতার টাকা উত্তোলনে দৌড়ঝাঁপ করতে এক দফতর থেকে অন্য দফতরে দিনের পর দিন নয়, বছরের পর বছর শেষ হয়ে যাচ্ছে; কিন্তু টাকার অভাবে আনন্দের মুখ দেখতে পাচ্ছেন না। পরিতাপের বিষয়, অনেকে নিজের পেনশনের টাকা পাওয়ার আগেই মারা গেছেন। এমনকি তার উত্তরসূরিরা টাকাটা পাবেন এমন নিশ্চয়তাটুকুও দেখে যেতে পারেননি অনেকে। জানা গেছে, ৭৫ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী অবসর ভাতার আবেদন করে প্রতীক্ষার প্রহর গুনছেন। এর মধ্যে ৪৫ হাজার আবেদন এসেছে অবসর ভাতার ও ৩০ হাজার কল্যাণ ভাতার। ২০১২ সাল থেকে আবেদনগুলো জমা হলেও কোনোটারই সুরাহা হয়নি। সবক’টি আবেদন নিষ্পত্তি করতে আড়াই হাজার কোটি টাকার দরকার। একসঙ্গে এত টাকার সংকট অস্বাভাবিক নয়; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বছরভিত্তিক আবেদনের সুরাহা কেন করা হয়নি? এটা অজানা নয়, প্রতি মাসে শিক্ষকদের বেতন থেকে ৬ ভাগ হারে অবসর ভাতার জন্য কাটা হয়। এতে বছরে ২১৬ কোটি টাকা জমা হয়। আর বছর প্রতি আসা পেনশন আবেদন নিষ্পত্তি করতে লাগে ৪৩৬ কোটি টাকা। ২২০ কোটি টাকা ঘাটতি হলেও বেতনের কেটে নেয়া অর্থ দিয়েই তো অর্ধেক আবেদন মেটানো যায়। কিন্তু মনে হচ্ছে, রহস্যজনক কারণে শিক্ষকদের অবসরকালীন সুবিধা আটকে রাখা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ব্যানবেইজসহ সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানে পদে পদে হয়রানির মুখে ফেলা হচ্ছে শিক্ষকদের। যুগান্তরের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সংঘবদ্ধ একটি চক্র পেনশনপ্রাপ্তি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিক্ষকদের হয়রানি করছে। অর্থ সংকট দেখিয়ে শিক্ষকদের প্রাপ্য অধিকার দেয়া হয় না। এমনকি চেক হয়ে যাওয়ার পরও ঘুষ না দিলে তা বুঝে পান না শিক্ষক-কর্মচারীরা। আরও বড় খবর, সাবেক এক কর্মকর্তা শিক্ষকদের বেতন থেকে পাওয়া অংশ দিয়ে পেনশন আবেদন নিষ্পত্তি না করে তা বেসরকারি ব্যাংকে এফডিআর করেন। তার কারণেই হাজার হাজার শিক্ষক অবসর সুবিধা না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন বলে অভিযোগ। আমাদের দাবি, এর পেছনে কোনো ধরনের কমিশন বাণিজ্য ও শুভংকরের ফাঁকি আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিতে হবে।
শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। একে চাকরির দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে ব্রত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ফলে অন্য পেশার তুলনায় অপ্রতুল সুযোগ-সুবিধা সত্ত্বেও অনেকে এই মহান দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। এটা অজানা নয়, বেসরকারি শিক্ষকরা বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ও অন্যান্য সুবিধা নামমাত্র পেয়ে থাকেন। ফলে সবসময় কষ্ট করে তাদের জীবন ধারণ করতে হয়। শেষ বয়সে সঞ্চিত পেনশন দিয়ে কিছু একটা করার স্বপ্ন থাকে তাদের। লাখ লাখ ছাত্রছাত্রীর স্বপ্ন গড়া শিক্ষকদের স্বপ্নভঙ্গ বোধগম্য নয়।
আশার কথা, এরই মধ্যে সরকার কিছু টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। এফডিআরের টাকাও এসেছে। তাই দ্রুত শিক্ষকদের পাওনা পরিশোধের পাশাপাশি বরাদ্দ বাড়াতে হবে। জীবন সায়াহ্নে এসে শিক্ষকরা হয়রানিমুক্তভাবে নিজেদের অধিকার ভোগ করবেন- এটাই কাম্য।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.