এই উপমহাদেশের ত্রিপুরা রাজাগণের স্বাধীন আমল হতে প্রাচীন পাহাড়িদের ঘরে ঘরে আলপালন উৎসব পালিত হয়। চলতি ১৪২৬ ত্রিপুরাব্দের ৩১ তালক্রান, ১৪২৩ বাংলার আষাঢ় মাসের ৭ তারিখ, ইংরেজি দিনক্ষণ হিসেবে ২১জুনে। প্রতিবছর এই দিনে (আষাঢ় ৭) পালন করা হয় উৎসবটি।
শতাব্দীর পর শতাব্দীকাল ধরে উৎসব উদযাপনে ব্যতিক্রম ছিল না। বর্তমানেও নয়। বরং নতুন সমারোহ আর আনন্দ উদযাপনের ভেতর দিয়ে ত্রিপুরা ও চাকমা জনগোষ্ঠীর মানুষ পালন করছে এই উৎসব।
আধুনিকতার ছোঁয়ায় এবং শহুরে ব্যস্ততায় এই উৎসব পালনের সমারোহ নিয়ে খুব যে বেশি মানুষ জানে, তা নয়। বর্তমান জামানায় শহুরে কর্মময় জীবন আর আকাশসংস্কৃতির প্রভাবে অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা এই উৎসব সম্পর্কে জানেন না, কেন এই উৎসব পালন করা হয়। অথবা উৎসব সম্পর্কে জানলেও কাজের ব্যস্ততায় ভুলেই যান আর পালন করার সুযোগও হয় না।
শুধু তাই নয়, শহুরের ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর নতুন প্রজন্মদের কাছেও এই উৎসব একেবারে নতুন। অবশ্য এর কারণ হলো, অন্য প্রভাবশালী সম্প্রদায়ের কারণে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সময়ের বিবর্তনে প্রায়ই তাঁদের অতীত ঐতিহ্য ভুলে গেছে। অথবা সমাজের চারপাশে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের চলতি উৎসবগুলো এতটাই জমজমাট হয় যে, এ রকম প্রকৃতিবান্ধব উৎসবগুলো সবার অগোচরে হারিয়ে যায়।
আলপালন উৎসব উদযাপন অনেকটা বৈসু (বিজু, বিহু, বিষু, চৈত্র-সংক্রান্তি ইত্যাদি) উদযাপনের মতো। পার্থক্য কেবল বৈসু উদযাপন হয় তিন দিন এবং বহু জনগোষ্ঠী এ উৎসব উদযাপন করে থাকে। কিন্তু আলপালন উৎসব হয় সাধারণত একদিন আর পালন করে প্রধানত ত্রিপুরা ও চাকমাসহ কয়েকটি জনগোষ্ঠীর মানুষ।
আলপালন কী
‘আলপালন’—আল মানে হাল চাষ আর পালন মানে এখানে বন্ধ বা নিষিদ্ধ করা বোঝায়। তাই এ দিনে হাল চাষ করা থেকে বিরত থাকে জুমিয়া কৃষকরা। শুধু হাল চাষ নয়, দা, কোদাল, শাবলসহ যেকোনো কিছু দিয়ে মাটি আঘাত করা, গাছপালা কাটা, লতাপাতা ছেঁড়া, ফলমূল ছেঁড়া থেকে সম্পূর্ণ বিরত রাখা হয়। এদিন প্রত্যেক ত্রিপুরা-চাকমার ঘরে ঘরে হাঁস, মুরগি, শূকর কাটা হয়। না পারলেও একটা মুরগি কাটা হবে। প্রকৃতিপূজারি জনগোষ্ঠীরা পৃথিবীকে ‘মাতা’ বা ‘নারী’ হিসেবে জানেন।
তাঁদের বিশ্বাস, প্রতিবছর আষাঢ় মাসের ৭ তারিখে বসুন্ধরা মায়ের ঋতুস্বাব হয়। যা মানুষ নারীর প্রতি মাসে হয়ে থাকে। ঋতুস্রাবে মায়ের শরীর অশুচি হয়, তাই ঘরে ঘরে হাঁস-মুরগি কেটে শুচি করা হয়। এবং পৃথিবী মাতার ঋতুস্রাবের এই দিনে তাঁকে আঘাত করলে ভীষণ কষ্ট পাবে জেনেই তাঁরা মাটির ওপর আঘাত করা থেকে বিরত থাকেন। আর পৃথিবী যদি কষ্ট পায়, তাহলে সে পরবর্তীকালে মানুষের ওপর প্রতিশোধ নিতে পারে বলেও তাঁদের বিশ্বাস।
প্রাকৃতিক দুর্যোগকে আদিম জনগোষ্ঠী পৃথিবীর ওপর মানুষের নিয়মিত আঘাতের প্রতিশোধ হিসেবে ধরে নেয়। ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড়, তুফান, সুনামি—এসবই প্রকৃতির প্রতিশোধমূলক আচরণ বলে তাঁদের বিশ্বাস। তাই সনাতন ধর্মাবলম্বী ও প্রকৃতির পূজারি ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীরা বড় বড় গাছ, ছড়ানদী, বড় পাথর, বন-পাহাড়, গ্রহ-নক্ষত্রকে দেবতার আসনে বসিয়ে পূজা করে থাকে।
এই উৎসব পালনের মধ্য দিয়ে পাহাড়ি জুমিয়া কৃষক পরিবার কাজে একদিন বিশ্রামও গ্রহণ করে থাকে।
কেবল আনুষ্ঠানিক উৎসব উদযাপন নয়, জুম চাষের জঙ্গল কাটার আগেও ত্রিপুরা জুমিয়ারা বন বা পাহাড় দেবতার কাছে অনুমতি নিয়ে থাকেন। যদি স্বপ্নে বনদেবতা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে থাকে, তাহলে ওই বছর সে আর ওই পাহাড়টিতে জুম চাষ করবে না। অন্যত্র গিয়ে পাহাড় দেখবে একই নিয়মে। যদি কোনোটাই অনুমতি না পায়, তাহলে সে সেই বছর জুম চাষই করবে না তাঁরা।
আলপালন ও তাইয়ুং-তকচিং
আলপালনের সঙ্গে দুই ধরনের বিশালাকার পাখিরও সম্পৃক্ত রয়েছে। আষাঢ় মাসের ৭ তারিখের দিনে অথবা বেশ কিছুদিন আগে থেকে ঝড়-বৃষ্টি অবশ্যই হবে। আর এ সময় তাইয়ুং ও তকচিং (ধনেশ) পাখির বাচ্চা গর্ত থেকে মুক্ত হয়। মাটির গর্ত বলে বৃষ্টির পানিতে না ভিজলে পাখির বাচ্চাগুলো গর্ত থেকে বেরোতে পারত না। তাই আলপালনের সঙ্গে এ তাইয়ুং-তকচিং পাখিরও একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। ধনেশ পাখির গর্ত যতক্ষণ না পর্যন্ত বৃষ্টির পানিতে ভিজে নরম হয়ে বাচ্চামুক্ত না হবে, ততক্ষণ বৃষ্টি হতে হবে।
ককবরকে (ত্রিপুরা ভাষায়) তাইয়ুং ও তকচিং নামে দুটো প্রজাতি বিশালাকার পাখি রয়েছে। যা আজ থেকে ২০-২৫ বছর আগেও তিন পার্বত্য জেলার পাহাড়ের আনাচে-কানাচে দেখা মিলত। এ দুই প্রজাতি পাখির নাম ত্রিপুরা লোককাহিনীতেও শোনা যায়।
Taiyung আকারে Tokchwing-এর চেয়ে বিশালাকার। অতীতে এই দিনে গর্ত থেকে মুক্ত হওয়ার পর Taiyung পাখি ঝাঁক বেঁধে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যেত। বাড়ির ভেতরে থাকলেও Taiyung ওড়ার শব্দ শুনতে পাওয়া যেত শোঁ শোঁ শব্দ।
ঠিক এই দিনে ত্রিপুরারা উড়ন্ত Taiyung পাখির ঝাঁক দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকত। এখন এ কথাগুলো কেবলই গল্প।
আশি-নব্বই দশকের দিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্ত পরিস্থিতির সময় গভীর বন-পাহাড়ের বিশাল বিশাল শতবর্ষী গাছপালা নিরাপত্তার অজুহাতে সেনাবাহিনীরা কেটে উজাড় করে দেয়। ফলে এখানকার বড় গাছপালা ধ্বংস হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে এ পাখি প্রজাতির আবাসস্থলও ধ্বংস হয়ে যায়। জুম চাষের ভূমি বেদখল করে রাষ্ট্র বন বিভাগকে দিয়ে সংরক্ষিত বন নির্ধারণের নামে সেখান সেগুন বাগান এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডকে দিয়ে রাবার বাগান গড়ে তোলা হয় ব্যাপক হারে।
এতে করে জুম চাষের পাহাড় হারিয়ে ভূমিহীন হয়ে পড়ে পাহাড়িরা, তেমনি পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক বনে গড়ে ওঠে সামাজিক-বাণিজ্যিক বনায়ন। বনায়নের ফলে প্রাকৃতিক বন ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হয়েছে অনেক দেশি-পরিচিত পশু-পাখির প্রজাতি। হারিয়েছে জীববৈচিত্র্যও।
ত্রিপুরাদের কোনো পার্বণ মানেই আনন্দের উৎসব। আর উৎসবে চলে চক-গালা আর পিঠা-পায়েস ও মাংস ভোজন উৎসব। চলে নানা রকমের চক-গালার পান। সাধারণত উৎসব-পার্বণেই নানা ধরনের চক-গালা তৈরি করে থাকে পাহাড়ি নারীরা, যা অন্যান্য দিনে হয় না। কয়েক প্রকার চক বা চুয়াকের (মদ) মধ্যে রয়েছে, চক, গালা, ব্রান্টি, বতক উৎসব। আলপালন উৎসবে ঘরে ঘরে মদ পান আর মাংস ভোজন করে বেড়ায় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নারী-পুরুষ। আনন্দ করে শিশু-কিশোররাও।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.