২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা বর্তমান সরকারের তিন বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। এ উপলক্ষে জনগণ ও বিরোধী দলের পাশাপাশি সরকারও পেছন ফিরে তাকাবে এবং আত্মবিশ্লেষণ করবে বলে আমাদের বিশ্বাস। সরকারকে তার দ্বিতীয় বছরের মতো তৃতীয় বছরটিতে কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন মোকাবেলা করতে হয়নি। তবে তৃতীয় বছরে সরকারকে জঙ্গি মোকাবেলায় ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয়েছে। গত বছর ১ জুলাই রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে। এর পরপর কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদ জামাতের অদূরে জঙ্গি হামলার ঘটনায় নিহত হয় আরও কয়েকজন। এ দুই হামলা দেশে জঙ্গি তৎপরতার বিষয়ে বিদেশীদেরও উদ্বিগ্ন করে তোলে। ফলে সরকারকে ভাবমূর্তির সংকট মোকাবেলা করতে হয়। এ দুই ঘটনার পর আইনশৃংখলা বাহিনী জোরালো জঙ্গিবিরোধী অভিযান শুরু করে এবং এতে বেশ সাফল্যও মেলে। তবে গত এক বছরে দেশে জঙ্গিবাদ বিস্তারের যে আলামত লক্ষ্য করা গেছে, তা সরকারের জন্য বিশেষ সতর্কবার্তা বটে। মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ তথা যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেয়া এবং শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির রায় কার্যকর করার ক্ষেত্রে সরকারের দৃঢ় অবস্থানকে মানুষ ইতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখছে। এ ক্ষেত্রে সরকার তার প্রতিশ্রুতি যথাযথভাবে রক্ষা করে চলেছে সন্দেহ নেই।
বর্তমান সরকারের আমলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল- বাংলাদেশ-ভারত ও বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের উন্নয়ন। ভারতের সঙ্গে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে দু’দেশের ছিটমহলগুলো বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে ছিটমহলবাসীর ৬৮ বছরের অবরুদ্ধ জীবনের অবসান হয়েছে এ সরকারের আমলেই। অর্থনীতির ক্ষেত্রে স্বল্পআয়ের দেশ থেকে বাংলাদেশের নিন্মমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার বিষয়টিও একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হওয়া এবং এর অগ্রগতির বিষয়টি দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার একটি নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বেড়েছে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারও। এগুলো ইতিবাচক। তবে বিনিয়োগে স্থবিরতা কাটেনি এখনও। গ্যাস-বিদ্যুৎ-অবকাঠামো সংকট, ব্যাংক ঋণে উচ্চ সুদের হার অব্যাহত থাকা এর অন্যতম কারণ। পাশাপাশি দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশে উদ্যোক্তাদের আস্থার অভাবকেও বিনিয়োগ-স্থবিরতার কারণ বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
উদ্যোক্তাদের আস্থার অভাবের কারণ, দেশে রাজনৈতিক পরিবেশ শান্ত হলেও এক ধরনের অস্বস্তি এখনও বিরাজমান; বলা যায় অস্থিরতার উপাদান রয়ে গেছে সুপ্তাবস্থায়। এর কারণ, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক ছিল না। সংসদে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। সেইসঙ্গে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচি পালনে বাধা প্রদান এবং নেতাকর্র্র্মীদের ওপর হামলা-মামলায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড একরকম ঝিমিয়ে পড়েছে। সরকারবিরোধী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার বেশিরভাগই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে তাদের অভিযোগ। আইনশৃংখলার ক্ষেত্রে জঙ্গিবাদের বিস্তার ছাড়াও অপহরণ, গুম ও হত্যার ঘটনা ঘটছে অব্যাহতভাবে। আঘাত এসেছে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর। এসব ঘটনা আতংক জাগিয়ে তুলেছে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোর মানুষের মনে। বস্তুত মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রশ্নে সরকারের অনেক সাফল্য ম্লান হয়ে যাচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গণতন্ত্র ও সহনশীলতার জায়গাটিতে সরকারের দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। দেশের উন্নতি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণে এর কোনো বিকল্প নেই।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.