কোনো প্রকল্প তৈরির আগে বিষয়টি নিয়ে বড় ধরনের গবেষণা করতে হয়। জনগণের জন্য যে প্রকল্প সমস্যার সমাধান আনবে তার জন্য ফিজিবিলিটি স্টাডি অত্যন্ত জরুরি, বিশেষ করে কোনো বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গেলে। তা না করা হলে উদ্দেশ্যটিই যে মাঠে মারা যায় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ মহুরি-কহুয়া বন্যানিয়ন্ত্রণ, নিষ্কাশন ও সেচ প্রকল্পটি। অপরিকল্পিত এ সেচ প্রকল্পটি বর্তমানে জনগণের গলার ফাঁস হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রকল্পটি ফেনী জেলার পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলার অধিকাংশ এলাকা এবং ছাগলনাইয়া উপজেলার কিছু অংশে বিস্তৃত। ২০০৫ সালে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণের লক্ষ্যে কোনো জরিপ ছাড়াই ১০০ কোটি টাকার বরাদ্দ এনে বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়। তৎকালীন স্থানীয় সংসদ সদস্যের উদ্যোগে এ কাজ আরম্ভ করা হয়। ধারণা করা যায়, তিনি তার এলাকার জনগণের উপকারার্থেই এ কাজে উদ্যোগী হন। কিন্তু জরিপ বা স্টাডি ছাড়াই এ কাজ শুরু হয়। প্রকল্পটি ২০০৪ সালের জুলাই থেকে ২০১০ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা ছিল। তবে তা সমাপ্ত হয় ২০১২ সালের জুনে। প্রকল্পের মূল অনুমোদিত ব্যয় ছিল ১৫০ কোটি ৬০ লাখ টাকা। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নকালীন কয়েকটি অংশের কাজের পরিমাণ পরিবর্তনের কারণে ব্যয় কমে দাঁড়ায় ১৩৯ কোটি ২৯ লাখ ৩৯ হাজার টাকায়।
সরকারের প্রকল্প তদারকি সংস্থা বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) এ প্রকল্প নিয়ে মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলেছে, রাবার ড্যামটি সচল নয়। তৈরির পর একবারও ব্যবহার হয়নি। বর্তমানে এটি কৃষকদের প্রয়োজনে ব্যবহার হয় না। কয়েকটি স্লুইস গেট অকেজো। প্রকল্প বাস্তবায়নের পর নদী ও খালের গভীরতাও অনেক কমে গেছে।
এসব বিষয় পর্যালোচনা করলে প্রকল্পটি সম্পর্কে একটি নেতিবাচক মূল্যায়ন ধরা পড়ে। এটি এত বড় প্রকল্প অথচ তা নিয়ে কোনো স্টাডি, কোনো গবেষণা করা হয়নি। শত শত কোটি টাকার প্রজেক্ট কত হেলাফেলাতেই না করা হয়েছে। এ যেন সরকারি মাল দরিয়ামে ডাল। পানি উন্নয়ন বোর্ডও যে কেমন করে এ ধরনের প্রকল্পে চোখ-কান বুজে সমর্থন জুগিয়েছিল তাও বোঝা দায়। বরং সে সময় তারা ও স্থানীয় দলীয় নেতারা গ্রামের সাধারণ মানুষের বাড়িঘর ভেঙে কোনোরকম ক্ষতিপূরণ না দিয়ে বাঁধের পাশ ঘেঁষে বালি ও মাটি খুঁড়ে বাঁধ নির্মাণ করে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ও ভূমির মালিকদের ক্ষতিপূরণের টাকা না দিয়ে আত্মসাৎ করেন চারদলীয় নেতা ও ভূমি অফিসের কর্মকর্তারা। এসব ঘটনা জেনে বোঝা যায় সরকারি কর্মকর্তাদের অসৎ উপার্জনের ধারা ওরকম। এর আগে পাকিস্তান আমলে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরার ডিএনডি বাঁধ নিয়েও যে অগ্রপশ্চাৎ কিছু ভাবা হয়নি, তা বর্তমানে সে অঞ্চলে মানুষের ভোগান্তি দেখে বোঝা যায়। সে সময় ৫৭ বর্গকিলোমিটার এলাকা বন্যামুক্ত রাখতে নির্মাণ করা হয় ডিএনডি বাঁধ। আজ সেখানে একটু বৃষ্টিজলেই রাস্তা-ঘরবাড়ি সবই পরিণত হয় জলাশয়ে। এখন তাই ডিএনডি যেন মরণবাঁধ।
এসব জেনেও অপরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয় মহুরি-কহুয়া বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ। বর্তমানে এ ড্যামটি ব্যবহৃতই হচ্ছে না। এরই মধ্যে ড্যামে চিথলিয়া ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের দুর্গাপুর এলাকায় দুটি ফাটল দেখা গেছে। এ ছাড়া সালিয়াগাট মধ্যশ্রীচন্দ্রপুর-গডিয়া সোনাপুরে নদীর দুই তীরে বাঁধ ক্ষয় হয়ে গেছে। এ কারণে মহুরি নদীর ডান তীরে বাঁধটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে আছে। তাই উচিত হবে এ বাঁধ নির্মাণে সরকারি কাজে যারা যুক্ত ছিলেন তাদের কাছে জবাবদিহি চাওয়া। তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করা। ভবিষ্যতে কোনো প্রকল্পই যেন আর ফিজিবিলিটি স্টাডি ছাড়া না করা হয় সে বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখা।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.