আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে, একেবারে খাঁটি খ্রিস্টান শেষকৃত্য অনুষ্ঠান চলছে। চার জনের কাঁধে বাহিত হয়ে এগিয়ে চলেছে একটি কফিন। কফিনের ঢাকনা বন্ধ, শুধু এক দিকের উন্মুক্ত একটি অংশ দিয়ে দেখা যাচ্ছে কফিনের ভিতরে শায়িত মানুষটির মাথা। চোখ বোজা অবস্থায় নিথর হয়ে রয়েছে সেই মাথা। কফিনের পিছন পিছন চলেছেন কিছু মানুষ। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন কিছু পাকা মাথার বৃদ্ধাও, যাঁরা বুক চাপড়ে হাহাকার করে কাঁদছেন। বোঝাই যাচ্ছে, মৃত মানুষটির শোকেই তাঁরা আকুল। কিন্তু আর পাঁচটি অন্তিমযাত্রার সঙ্গে এই শোভাযাত্রার কিছু ভয়াবহ পার্থক্যও রয়েছে। প্রথমত, একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, কফিনের পেছনে ক্রন্দনরতা বৃদ্ধাদের সহযাত্রী হিসেবে রয়েছেন আরও কিছু মানুষ, যাঁদের চোখেমুখে শোকের লেশমাত্রও নেই। বরং মদের বোতল হাতে নেশায় টলমলায়মান অবস্থায় হর্ষধ্বনি আর হাততালির মাধ্যমে তাঁরা উজ্জীবিত করে চলেছেন একে অন্যকে। আর তার থেকেও ভয়াবহ তথ্য যেটি, সেটি হল এই যে, কফিনের ভিতরে যিনি শুয়ে রয়েছেন, তিনি আদৌ মৃত নন, বরং জলজ্যান্ত একটি মানুষ।
কিউবার রাজধানী হাভানা থেকে ১২ মাইল দূরবর্তী সান্তিয়াগো দে লাস ভেগাস গ্রামে অনুষ্ঠিত ‘বারিয়াল অফ প্যাচেন্দো’ নামের এক বিচিত্র উৎসবের অংশ হিসেবেই কবর দেওয়া হয় এক জন জীবন্ত মানুষকে। ১৯৮৪ সাল থেকে প্রতি বছর ৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে পালিত হয়ে আসছে এই উৎসব। বছরের গোড়ার দিকেই গ্রামের এক জনকে নির্বাচন করা হয় ‘প্যাচেন্দো’ হিসেবে, অর্থাৎ উৎসবের দিনে যাঁকে কবর দেওয়া হবে। তারপর নির্দিষ্ট দিনে কফিনের মধ্যে তাঁকে শোওয়ানো হয়। শুরু হয় ‘শোকযাত্রা’। ‘শোকযাত্রা’-য় অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ মানুষই থাকেন নেশার ঘোরে। চলে হাততালি, গান, উল্লাস। কিন্ত একটি অন্তিমযাত্রায় অংশ নেওয়া সকলেই তো আর আনন্দে উৎরোল হতে পারেন না! তাই শোভাযাত্রায় রেখে দেওয়া হয় কিছু মহিলাকেও, যাঁদের দায়িত্ব ওই ‘প্যাচেন্দো’র বিধবা স্ত্রী হিসেবে শোকবিহ্বলতার অভিনয় করা। শোকযাত্রা সহ কফিন পৌঁছয় উৎসবের জন্যই আলাদাভাবে তৈরি করা কবরস্থানে। খোঁড়া হয় ছ’ফুট গভীর একটি কবর। উপস্থিত থাকেন ধর্মযাজকও। যথাবিহিত রীতি মেনে মানুষ সমেত কফিনটিকে শোওয়ানো হয় মাটির গভীরে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। ভূগর্ভে শায়িত কফিনকে ঘিরে কিছুক্ষণ হইহুল্লোড়ের পরেই আবার জীবন্ত মানুষটি সমেত কফিনটিকে তুলে আনা হয় উপরে।
কিন্তু এই বিচিত্র উৎসবের তাৎপর্য কী? কে-ই বা এই প্যাচেন্দো? স্থানীয় বাসিন্দা অ্যালভেরো হার্নান্দেজ দিলেন সেই প্রশ্নের উত্তর। তিনি জানালেন, “প্যাচেন্দো একেবারেই কল্পিত একটি চরিত্র। আসলে ১৯৮৪ সালে গ্রামবাসীরা একটি স্থানীয় কার্নিভালের অন্তসূচক একটি অনুষ্ঠান পালন করবে বলে স্থির করে। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয়, একটি ছদ্ম-অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আয়োজন করা হবে। সেই সময়ে শহরে একটা নাটক এসেছিল ‘বারিয়াল অফ প্যাচেন্দো’ নামে। গ্রামবাসীদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল সেই নাটক। হঠাৎ করে কোনও কারণ ছাড়াই আমাদের অনুষ্ঠানের নাম আমরা স্থির করি ‘বারিয়াল অফ প্যাচেন্দো’। ৫ ফেব্রুয়ারিকে যে এই বার্ষিক অনুষ্ঠানের জন্য স্থির করা হয়, সেটাও ওই রকম আকস্মিক সিদ্ধান্তেরই ফল।”
গ্রামবাসী ডিভাল্ডো অ্যাগুইয়ার বিগত তিরিশ বছরে বেশ কয়েকবার এই অনুষ্ঠানে ‘প্যাচেন্দো’ হয়েছেন। তিনি বললেন, “আদপে এটা কোনও শোকানুষ্ঠানই নয়, বরং জীবনকে ভালবাসার উৎসব। কবর থেকে যখন উঠে আসি, তখন যেন নতুন করে জীবনকে ফিরে পাই, নতুন করে বুঝতে পারি জীবনের মূল্য। ‘প্যাচেন্দো’র মধ্য দিয়ে জীবনের মূল্য উপলব্ধি করেন প্রত্যেক গ্রামবাসীও।”
অতএব শোক নয়, বরং জীবন্ত ‘প্যাচেন্দো’কে কবর দিয়ে জীবনেরই জয়গান গেয়ে যেতে চান সান্তিয়াগো দে লাস ভেগাসের মানুষজন।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.