দেশীয় শিল্প সুরক্ষার দোহাই দিয়ে অনেকটা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের রীতিনীতি ভঙ্গ করেই ভারত সরকার সম্প্রতি বাংলাদেশের রফতানি করা পাটপণ্যের ওপর উচ্চ হারের অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্কারোপ করেছে।
নতুন এই পদক্ষেপের ফলে সে দেশে রফতানি অব্যাহত রাখতে হলে এখন থেকে প্রতি টন পাটপণ্য থেকে ভারত সরকারকে সর্বনিম্ন ২০ দশমিক ৩৫ থেকে সর্বোচ্চ ৩৫১ দশমিক ৭২ ডলার পর্যন্ত অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক দিতে হবে।
ভুক্তভোগী রফতানিকারকরা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্তকরণের আগে ভারত সরকার বাংলাদেশের ব্যবসায়ী এবং সরকারি প্রতিনিধিদের কোনো আবেদন-নিবেদনে সাড়া দেয়নি। একই সঙ্গে ব্যবসায়ীদের দেয়া তথ্যের পর্যাপ্ত পর্যালোচনা করা হয়নি।
তাদের মতে, অনেকটা গায়ের জোরে একতরফা সিদ্ধান্তেই ভারত বাংলাদেশের রফতানিকৃত পাটপণ্যের ওপর পাঁচ বছরের জন্য অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক বসিয়েছে।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নিয়ম অনুযায়ী, ডব্লিউটিওর সনদে স্বাক্ষরকারী কোনো দেশ একতরফাভাবে অন্য দেশের পণ্যের ওপর এই শুল্ক আরোপ করতে পারে না। কিন্তু ভারত সরকার সে দেশের ব্যবসায়ীদের ঠুনকো অনুরোধে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার মতো পদক্ষেপ নিয়ে ডব্লিউটিও’র এই বিধান সুস্পষ্টভাবেই ভঙ্গ করেছে। এটা ডব্লিউটিও সনদের পরিপন্থী।
বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএমএ) সূত্র জানিয়েছে, একতরফাভাবে বাংলাদেশের পাট ও পাটপণ্যের ওপর ভারতের অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক আরোপের নেতিবাচক প্রভাব ইতিমধ্যে পড়তে শুরু করেছে।
চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি ভারতের রাজস্ব বিভাগ থেকে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারির পর গত এক সপ্তাহে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের দেড় শতাধিক কোটি টাকার পাট ও পাটপণ্য রফতানি আটকে গেছে ভারতে। এই নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন রফতানিকারকরা।
তাদের মতে, ভারতের এ সিদ্ধান্তে চলতি অর্থবছরেই রফতানিযোগ্য এক লাখ টন পাটপণ্য রফতানি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ফলে এ খাতে লোকসানের অংক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
এদিকে ভারতের এই পদক্ষেপের ফলে কোনোরকম বাণিজ্যিক বিরোধে না জড়িয়ে সমস্যা সমাধানে কৌশলগত পদক্ষেপ নিয়েই হাঁটছে বাংলাদেশ। কারণ আইনি কাঠামোর মধ্যে এ বিষয়ে সমাধান করতে গেলে দীর্ঘ সময় লেগে যেতে পারে। ততদিনে আরও বেশি ক্ষতির শিকার হবে দেশের পাট খাত। এ পরিস্থিতিতে কূটনৈতিক পথেই সমস্যার সমাধানকে শ্রেয় মনে করেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা।
এর প্রাথমিক কৌশল হবে বাংলাদেশ থেকে সরকার মনোনীত উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি ভারতে পাঠিয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে এই তিক্ত সম্পর্কের অবসান ঘটানোর উদ্যোগ নেয়া হতে পারে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, দ্রুতই এ পদক্ষেপ দেখা যেতে পারে।
বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন সূত্র জানিয়েছে, আইনগত যেসব মৌলিক অধিকার রয়েছে তা-ও প্রয়োগ করবে বাংলাদেশ। ইতিমধ্যে এ বিষয়ে পরবর্তী কৌশল নির্ধারণের জন্য ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সঙ্গে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন প্রয়োজনীয় শলাপরামর্শ শেষ করেছে। করণীয় নির্ধারণ সংক্রান্ত ওই সভায় সর্বসম্মতভাবে ভারতের এই পদক্ষেপকে অযৌক্তিক ও অনৈতিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। একই সঙ্গে এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী রফতানিকারকদের একযোগে কেস টু কেস ভিত্তিতে ভারতের ট্যারিফ কমিশন এবং সেখানের আদালতে গিয়ে মামলা করা এবং তা মোকাবেলার পরামর্শ দেয়া হয়।
নিয়ম অনুযায়ী, গেজেট প্রকাশ হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে এ মামলা করার সুযোগ রয়েছে। সেখানেও যদি প্রতিকার না মিলে তাহলে সবাইকে ডব্লিউটির হেয়ারিং কোর্টে আপিল করারও সুযোগ পাবে বাংলাদেশ।
ইতিমধ্যে ট্যারিফ কমিশনের এই সুপারিশ সংক্রান্ত কৌশলপত্রে স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে ব্যবসায়ীদের আইনি পথে লড়াইয়ে যাওয়ার সব বাধা দূর করে দিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ।
তবে পাটপণ্যের ওপর ভারতের অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক আরোপের জন্য বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদেরই দায়ী করেছেন বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম।
ভারত সরকার নতুন করে এই শুল্ক নির্ধারণের বিষয়টি প্রজ্ঞাপন আকারে জারির পর এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের অসহযোগিতার কারণেই ভারত একতরফাভাবে এ সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে। কিন্তু যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে।
এখন শুল্কারোপের বিষয়টি জানার পর সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করে ডব্লিউটিওর কাছে আপিল করা হবে। দ্রুতই এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে। তবে একই সঙ্গে আইনগত ব্যবস্থা ছাড়াও কূটনৈতিক ও পারস্পরিক সম্পর্কের মাধ্যমে বিষয়টি মোকাবেলা করার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আগামী মাসেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে এ বিষয়ে একটি নোটশিট দেয়ার প্রচেষ্টা থাকবে। এ বিষয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন বলেন, ভারত বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম দেশ। তারা এ ধরনের পদক্ষেপ নিলেও আমরা মনে করছি এটি সাময়িক। এর আগেও একবার ব্যাটারির ওপর এমন একটি কর আরোপ করেছিল ভারত। তখনও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা আদালতে গিয়েছিল। সে সময় আদালত বাংলাদেশের পক্ষেই রায় দিয়েছিলেন। তবে এবারের পদক্ষেপটি বন্ধুপ্রতিম হিসাবে সমঝোতার সঙ্গেই মোকাবেলা করতে চাই। দ্বিপক্ষীয় আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই সেটি সমাধান সম্ভব। তবে এর বাইরে সম্ভাব্য সব ধরনের প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেয়ারও সুযোগ রাখা হবে। ক্ষতিগ্রস্ত রফতানিকারকরা তারা তাদের নিজেদের মতো করে পদক্ষেপ নিতে পারবেন। সেক্ষেত্রে তারা ভারতের অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে।
এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে তাদের এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় অনুমতিপত্র দেয়া হয়েছে। তবে এ ধরনের উদ্যোগে সব রকম ব্যয় বহন করবে ব্যবসায়ীরাই। সরকার শুধু ব্যবসায়ীদের সব ধরনের টেকনিক্যাল ও লজিস্টিক সাপোর্ট দেবে।
বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান আবুল হোসেন বলেন, এ সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ে থাকলে মামলা করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই।অবশ্য ভারতীয় দূতাবাসের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানিয়েছে, হঠাৎ করেই বাংলাদেশের পাটপণ্যের ওপর অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক বসায়নি ভারত।
এর জন্য দুই বছর আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়েছে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ডিরেক্টরেট জেনারেল অব অ্যান্টি ডাম্পিং অ্যান্ড অ্যালাইড ডিউটিজ (ডিজিএডি)। এরপর প্রায় এক বছর এ নিয়ে তদন্ত চলছে।
সূত্র আরও জানায়, ভারতের ডিজিএডি যখন তদন্ত শুরু করে তখন আত্মপক্ষ সমর্থন করে বাংলাদেশের রফতানিকারকরা সেভাবে এগিয়ে আসেনি। তদন্তকালে তাদের কাছে পাটপণ্যের রফতানি মূল্য, প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ক্ষমতা, বার্ষিক বিক্রির পরিমাণসহ বেশকিছু বিষয়ে জানতে চায় ডিজিএডি। কিন্তু সেসব প্র্রশ্নের উত্তর দিয়ে তদন্তে অনেকেই সহযোগিতা করেনি।
এ তথ্য জানিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে চিঠিও দিয়েছিল ডিজিএডি। এরপর যারা সহযোগিতা করেছে তাদের প্রদেয় তথ্যেও ছিল যথেষ্ট ঘাটতি।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.