কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে উচ্চ সুদ হলেও ঋণ নিতে মরিয়া একটি মহল। এ জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর চ্যালেঞ্জকে অজুহাত হিসেবে দেখানো হচ্ছে।
বিশেষ করে চীন ও রাশিয়ার মতো দেশ থেকে প্রায় ৩ থেকে সাড়ে ৩ শতাংশ সুদ এবং বিভিন্ন শর্তযুক্ত হলেও অর্থ খোঁজা হচ্ছে। এ ধরনের ঋণ অধিক হারে নিলে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের গলার কাঁটা হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তাদের মত হচ্ছে, চড়া সুদের এ সব ঋণ ভেবে-চিন্তে নেয়া উচিত। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে এ সব তথ্য জানা গেছে।
সূত্রমতে, রাশিয়া এবং চীন থেকে শর্তযুক্ত ঋণ নিতে একাধিক প্রকল্প বাছাই করা হচ্ছে। এরমধ্যে অন্যতম মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলায় ৩৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র (দ্বিতীয় ইউনিট), ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, অ্যাপ্রোচ ক্যানেল, ড্রেজিং অ্যান্ড পোর্ট কনস্ট্রাকশন অ্যাট মহেশখালি পাওয়ার হাব প্রকল্প এবং কনস্ট্রাকশন অব মহেশখালি ১৩২০ মেগাওয়াট কোল ফায়ারড আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রজেক্ট।
এ প্রসঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সচিব কাজী শফিকুল আযম বৃহস্পতিবার বলেন, ঋণ জিডিপির যে হার এতে করে এখনও অনেক ঋণ নেয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এ সব ঋণ নিতে হবে ভালো প্রকল্পে, অর্থাৎ যে সব প্রকল্প থেকে রিটার্ন আসবে। তাছাড়া প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে কিছুটা চড়া সুদে ঋণ নিতে হবে। এতে শংকার কিছু নেই।
উচ্চ সুদ ও শর্তযুক্ত ঋণ প্রসঙ্গে বাংলাদেশে কর্মরত আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এক বিশেষজ্ঞ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সরকারের মধ্যেই অনেকে প্রভাবশালী ব্যক্তি রয়েছেন, যারা চীন বা রাশিয়ার মতো দেশ থেকে ঋণ নিতে আগ্রহের সৃষ্টি করেন। এতে বড় অংকের কমিশন পাওয়ার সুযোগ থাকে।
তিনি জানান, বাংলাদেশের ঋণ নেয়ার সুযোগ রয়েছে কিন্তু যদি চীন ও রাশিয়ার মতো চড়া সুদ ও শর্তযুক্ত ঋণ অধিক হারে নেয়া হয় তাহলে এক সময় সেই সুযোগের জায়গা পূরণ হয়ে যাবে। তখন দেখা যাবে ঋণ থাকবে, কিন্তু সেই ঋণ ব্যবহার করে উৎপাদন বৃদ্ধি কিংবা রাজস্ব আদায় করে সেই ঋণ পরিশোধ করা যাবে না। ফলে স্পেন ও পর্তুগালের মতো ঋণ জর্জরিত দেশে পরিণত হতে পারে বাংলদেশ। সেই সঙ্গে দেউলিয়া হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। তাই সরকারকে এখন থেকেই সতর্ক হওয়া উচিত। তিনি আরও বলেন, এ সব ঋণে যে সব প্রকল্প বাস্তবায়িত হয় তার মান নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন থাকে।
অনেক সময় বলা হয়, বাংলাদেশ ওই সব দেশের ডাম্পিং গ্রাউন্ড। অর্থাৎ বিশ্বের কোথাও যে সব মালামাল ও পণ্য সরবরাহ করা যায় না। এরকম ঋণের প্রকল্পে সে সব পণ্য বা মালামাল সরবরাহ করা হয়। সে ক্ষেত্রে মান নিয়েও কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ থাকে না।
ইআরডি সূত্র জানায়, ইতিমধ্যেই চীন সরকারের কাছে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলায় ৩৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রথম ইউনিট স্থাপনের জন্য ঋণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সম্প্রতি বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে ৩৫০ মেগাওয়াটের আরও একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য নতুন করে ঋণ প্রস্তাব দেয়ার জন্য ইআরডিকে অনুরোধ জানানো হয়।
এতে বলা হয়েছে, প্রথম ইউনিট প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য নিয়োজিত কন্সালটিং ফার্ম যে খসড়া সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন জমা দিয়েছে সেখানে চূড়ান্ত মাস্টার লেআউট প্লান অনুযায়ী ৩৩০ একর জমিতে ৩৫০ মেগাওয়াট করে দুটি ৭০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্র্র স্থাপন সম্ভব। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যুতের উৎপাদিত মূল্য তুলনামূলক কম রাখতে দ্বিতীয় ইউনিট প্রকল্প স্থাপনে চীনের কাছে ঋণ প্রস্তাব করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, গত অক্টোবর মাসে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং-এর ঢাকা সফরের সময় কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ প্রকল্প, সিক্স ভ্যাসেল প্রকিউরমেন্ট এবং দাসেরকান্দি স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট প্রকল্পের ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। চীনের কাছে নেয়া এ সব ঋণকে নমনীয় ঋণ বললেও এ সব ঋণে ২ শতাংশ সুদ, ঋণ পরিশোধের মেয়াদ ৫ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ (এ সময়ে শুধু সুদ পরিশোধ করতে হয়) ২০ বছর, ম্যানেজমেন্ট ফি শূন্য দশমিক ২ শতাংশ, কমিটমেন্ট ফি শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ এবং চুক্তি কার্যকর হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে ম্যানেজমেন্ট ফি বাবদ নির্দিষ্ট অংকের টাকা পরিশোধ করতে হবে। তবে ইআরডির এশিয়া উইংয়ের এক কর্মকর্তা জানান, চীনের ঋণে প্রত্যেকটি প্রকল্পের জন্য আলাদা আলাদা সুদ এবং শর্ত নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।
অন্যদিকে সম্প্রতি বৈদেশিক সহায়তা অনুসন্ধান কমিটির ৩৮তম সভায় ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, অ্যাপ্রোচ ক্যানেল, ড্রেজিং অ্যান্ড পোর্ট কনস্ট্রাকশন অ্যাট মহেশখালি পাওয়ার হাব প্রকল্প এবং কনস্ট্রাকশন অব মহেশখালি ১৩২০ মেগাওয়াট কোল ফায়ারড আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রজেক্ট দুটি প্রস্তাব করা হয়। ইআরডিতে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে এ দুটি প্রকল্পে রাশিয়ার কাছে ঋণ প্রস্তাব পাঠানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।
এ ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, এ সব প্রকল্পে রাশিয়ান সরকার হতে ঋণ সংগ্রহণের জন্য প্রাথমিক উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) ইআরডির ইউরোপ অনুবিভাগে পাঠনোর সিদ্ধান্ত নেয়া হল। এ ছাড়া রাশিয়ান সরকার যাতে এ প্রকল্পে অর্থায়ন করে সে সম্ভাব্যতার বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণায়কে রাশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়েছে বৈদেশিক সহায়তা অনুসন্ধান কমিটি।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.