* নিউজিল্যান্ড সিরিজটা কেমন কাটল সব মিলিয়ে? সাকিব আল হাসান: দলের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে কোচ আর অধিনায়কই ভালো বলতে পারবেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, আমার জন্য টেস্ট সিরিজটা খুবই ভালো গেছে। ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টির ব্যাটিংটা আরেকটু ভালো হতে পারত। * দলের জন্য সিরিজটা কেমন হলো? সাকিব: যতটুকু হয়েছে, তার চেয়ে ভালো হওয়া উচিত ছিল। সুযোগ এসেছিল। কিন্তু আমরা ওইভাবে সেগুলো কাজে লাগাতে পারিনি দেখে হয়নি। গত এক-দেড় বছরের মতো আমরা সবাই যদি সমানভাবে অবদান রাখতে পারতাম, তাহলে ফলাফল অন্য রকম হতো। * টেস্টে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি পেলেন এই সিরিজে। নিউজিল্যান্ড সফরে বড় কিছুর পরিকল্পনা কি আগে থেকেই ছিল? সাকিব: না, সে রকম কিছু কখনো ছিল না। * ডাবল সেঞ্চুরি করার পর বলেছিলেন, আপনার স্ত্রী ক্যাচ মিস নিয়ে কিছু একটা বলার পর মনে মনে ঠিক করেছিলেন, ভালো কিছু করবেন। ডাবল সেঞ্চুরির আগের রাতে আপনাকে আপনার স্ত্রী ঠিক কী বলেছিলেন? সাকিব: (হাসি) আসলে ও সব সময়ই বিভিন্নভাবে অনুপ্রেরণা দেয়। হয়তো নিজের অজান্তেই এটা করে। তারপরও তো সেটা আমার জন্য অনুপ্রেরণা। * খোঁচা-টোঁচা মেরে কিছু বলেছিলেন নাকি উনি! পরদিন হয়তো সেটাই আপনাকে তাতিয়ে দিয়েছিল… সাকিব: (হাসি) এগুলো তো সারাক্ষণই বলতে থাকে। প্রতিদিনই বলে এ রকম। ভালো খেললেও বলে। * আপনি বললেন টেস্টের পারফরম্যান্স নিয়ে সন্তুষ্ট। তো ওয়ানডেতে কী সমস্যা হচ্ছিল? সাকিব: কোনো সমস্যাই না। আসলে ভালো ব্যাটিং করতে করতে প্রতিদিন আউট হয়ে গেছি। প্রথম ম্যাচে ভালো ব্যাটিং করছিলাম। ইনিংসটা অনেক বড় করতে পারতাম। এক শ মারার সুযোগ ছিল। ২০ ওভার হাতে ছিল। সেটা মিস করছি। এক ম্যাচে ১৮ করলাম, ওটা পুরোটা খেলা উচিত ছিল। উইকেট খুব ভালো ছিল, বোলিংও ওরকম হচ্ছিল না। সবই ঠিকঠাক ছিল। আউট হয়ে গেছি…এই আরকি। * সিরিজে আপনার দু-একটি আউট নিয়ে খুব সমালোচনা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বাজে শট খেলে আউট হয়েছেন। এসব আউট নিয়ে কী বলবেন আপনি? সাকিব: সব আউট নিয়েই তো হতাশা থাকে। সব আউটেই মনে হয়, আরেকটু খেলতে পারলে ভালো হতো। ২১৭ যেদিন করেছি, সেদিনও মনে হয়েছে আরেকটু ব্যাটিং করলে ভালো হতো। * বাজে আউটে বাড়তি কোনো অপরাধবোধ কাজ করে না? মনে হয় না যে, এটা কী খেললাম! সাকিব: প্রতিটা আউটেই অপরাধবোধ থাকে। নতুন করে আর কী বলব! তবে হ্যাঁ, গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আউট হলে মনে হয়, থাকলে তো দলের জন্য আরও বেশি কিছু করতে পারতাম। ওটা অবশ্যই মনে হয়। * আপনার দৃষ্টিতে এবারের নিউজিল্যান্ড সিরিজে সে রকম আউট কোনগুলো? সাকিব: আমার তো মনে পড়ে না, আমি শেষ কবে ভালো বলে আউট হয়েছি। এটা সত্যি কথা, আমি মনে করতে পারি না শেষ কবে বোলার আমাকে আউট করে উইকেট নিয়েছে। দু-একটা আউট হয়তো দুর্ভাগ্যজনকভাবে হয়েছি। তবে বেশির ভাগ সময়ই আমি নিজের ভুলে আউট হই। * এই ভুলগুলো সংশোধনের উপায় কী? সাকিব: মানসিক ব্যাপারই হয়তো। বাকি সবকিছুর চেয়ে এখানে মানসিকতাটাই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। মাইন্ডসেট ঠিক রাখা। মাইন্ডসেটটা সব সময় একই ফ্রেমে থাকে না। এটা অবশ্য কঠিনও। খুব কম খেলোয়াড়ই পারে একই মাইন্ডসেট নিয়ে প্রতিবার ব্যাটিং করতে। * কিন্তু আমরা তো জানি, সাকিব আল হাসানের মাইন্ডসেট অনেক পরিষ্কার। আপনি জানেন আপনাকে কী করতে হবে… সাকিব: হ্যাঁ, আমি জানি আমাকে কী করতে হবে। তা না হলে কীভাবে বুঝব, কোন পরিস্থিতি বা সময়টা গুরুত্বপূর্ণ, কোনটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমি তো বুঝি কোন সময়ে কী করা লাগবে। কিন্তু সব সময় বুঝলেও তা কাজে লাগানো যায় না। একজন মানুষের পক্ষে সবকিছু সব সময় একইভাবে করা সম্ভব নয়। সে যতই জানুক কী করা উচিত, সব সময় সে তা করতে পারে না। * সব সমস্যারই কোনো না কোনো সমাধান আছে। এই সমস্যাটা নিয়ে ভেবেছেন কখনো? কোনো কাজ করেছেন? সাকিব: (হাসি) সব সমস্যার সমাধান আছে, এটা আমি বিশ্বাস করি না। তবে এগুলো যত না কাজ করার, তার চেয়ে চিন্তাভাবনার বিষয় বেশি। আর কাজ তো করতেই থাকি। মানুষ কি কখনো চায় ইচ্ছা করে আউট হতে? চেষ্টা করি যত লম্বা সময় ব্যাটিং করা যায়, যত ভালো বোলিং করা যায়, যত বেশি উইকেট পাওয়া যায়। সবার সব সময় হয় না। ভাগ্যের একটা ব্যাপার থাকে। আমি যেহেতু ভাগ্যে বিশ্বাস করি, অনেক সময় আমার মনে হয়, ভাগ্যে না থাকলে কীভাবে হবে। * এসব ক্ষেত্রে অনেক সময় সমস্যাটা নিজের পক্ষে ধরা কঠিন। দ্বিতীয় কারও পর্যবেক্ষণ বা মতামত কাজে দেয়। এ নিয়ে কখনো কারও সঙ্গে কথা বলেছেন? সাকিব: হ্যাঁ, কথা তো হয়ই। সবকিছু নিয়েই কথা হয়। কিন্তু আমি যেহেতু এত দিন ধরে খেলছি, অভিজ্ঞতার কারণে দেখা যাচ্ছে বেশির ভাগ প্রশ্নের উত্তর আমার কাছেই আছে। আমিই জানি কী করতে হবে। কোচ, মেন্টর বা অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করার আগে ভাবি, প্রশ্নের উত্তরটা আসলে কী। দেখা যায়, আমার কাছেই বেশির ভাগ প্রশ্নের উত্তর থাকে। আমি জানি, টেস্টে ম্যাচে আমাকে গুড লেংথে বল করতে হবে। করে যেতে হবে, করে যেতেই হবে। এ রকম ৫-৭ ওভার বল করলে আমি একটা উইকেট পেতে পারি। এটা আপনিও জানেন। কিন্তু কেউ কি তা পারে? বেশির ভাগ সময় পারে না। বিশ্বের সেরা বোলার, সেও কি পারবে? পারবে না। চাইলেই বা সমস্যা জানলেই সমাধান হয়ে যাবে, বিষয়টা এমন নয়। স্কিল থাকলেও হবে না। কোনো মানুষই এক শ ভাগ সঠিক নয়। তবে যেসব বিষয়ে জানি না, সেগুলো নিয়ে অবশ্যই কথা বলি। * যেহেতু আপনি নিজে সন্তুষ্ট নন, ব্যাটিং নিয়ে কিছু কাজ করার দরকার আছে বলে কি মনে করেন? সাকিব: কাজ তো আসলে করেই যাচ্ছি। যত দিন ক্রিকেট খেলছি, বোলিং নিয়ে আমি খুব কমই কাজ করেছি। বেশির ভাগ সময় ব্যাটিং নিয়েই করি। এ কারণে রান করলে তৃপ্তিও বেশি থাকে। যেদিন আমার খেলা শেষ হবে, ওই দিন পর্যন্ত এটা চলবে। তারপরও দেখবেন সমস্যা থেকে যাবে। এটা শচীনের ক্ষেত্রেও হয়েছে, সাঙ্গাকারার ক্ষেত্রেও হয়েছে। * বাজে আউটগুলোর পর নিশ্চয়ই আপনি বুঝতে পারেন ওভাবে খেলা ঠিক হয়নি। এসব ক্ষেত্রে মনের ভেতর তাত্ক্ষণিক অনুভূতিটা কেমন হয়? সাকিব: খারাপ তো লাগেই। কিন্তু এখানে কী করার আছে, বলেন! * সমস্যা সমাধানের জন্য আপনি যা করছেন, সেটাকে যথেষ্ট মনে করেন? সাকিব: দুনিয়ায় কোনো কিছুই যথেষ্ট নয়। যথেষ্ট যে আসলে কী, সেটা কেউ কোনো মাপকাঠি দিয়ে নির্ধারণ করতে পারবে না। কারও জন্য দশ মিনিট ব্যাটিং করা যথেষ্ট। কারও দুই ঘণ্টা ব্যাটিং করতে হয়। একেক জনের ক্ষেত্রে একেক রকম। এটা কেউ পরিমাপ করে বলতে পারবে না যে, আমার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। * ডাবল সেঞ্চুরির পর তাৎক্ষণিক মনের অবস্থা কেমন ছিল? সাকিব: কিছুই মনে হয়নি। শুধু ব্যাটিং করছিলাম। ৫০ করার পর যে রকম ব্যাটিং করছিলাম, দেড় শ পার হওয়ার পর একই রকম ব্যাটিং করেছি। দুই শ পার হওয়ার পরও একই মানসিকতা ছিল। এ কারণেই বোধ হয় এত বড় ইনিংস খেলতে পেরেছি। সেদিন সব সময় আমার একই মাইন্ডসেট ছিল, যেটা সব সময় রাখা সম্ভব নয়। * সব সময় না হলেও আপনার পক্ষে বেশির ভাগ সময়ই এই মাইন্ডসেট ধরে রাখা সম্ভব। এখন থেকে কি সেটা দেখতে পাবে সবাই? যেহেতু এর সুফল আপনি পেয়েছেন… সাকিব: হ্যাঁ, বেশির ভাগ সময় এটা ধরে রাখা সম্ভব। আমি সব সময় চেষ্টা করিও এটা ধরে রাখতে। কখনো হয়, কখনো হয় না। তবে হ্যাঁ, একবার বড় ইনিংস খেললে আপনার একটা ধারণা হবে, কীভাবে বড় ইনিংস খেলা যায়। স্বাভাবিকভাবে এটা আমাকে ভবিষ্যতে সাহায্য করবে। * সাকিব আল হাসান অনেক রান করেন। বড় বড় ইনিংস খেলেন। কিন্তু তাঁর ব্যাটিং দেখে ভালো লাগে না—এ রকম একটা আলোচনা সব সময়ই আছে। আপনার মতো ব্যাটসম্যানের ব্যাটিংটা আরও শিল্পিত হতে পারে। এর সঙ্গে একমত? সাকিব: হতে পারে। সবার কাছে আমার ব্যাটিং ভালো লাগবে, এমন কোনো কথা নেই। আমার ব্যাটিং সবার চোখে সুন্দর লাগে, এই দাবি আমিও করব না। আমার ব্যাটিংয়ের চেয়ে অনেকের ব্যাটিংই অনেক বেশি সুন্দর। আমার ব্যাটিং সুন্দর নয়, এটা নিয়ে এত টেনশনের কিছু নেই। আমার মনে হয় না ব্যাটিং দেখতে সুন্দর লাগাটা কোনো ব্যাপার। * মুশফিকের সঙ্গে রেকর্ড জুটিটা কেমন উপভোগ করেছেন? সাকিব: ভালো লেগেছে। দুজনই প্রায় একই গতিতে রান করেছি। দুজনই নিজেদের মতো শট খেলেছি। * মুশফিকের সঙ্গে জুটিতেই মনে হয় আপনি বেশি স্বচ্ছন্দ… সাকিব: আমরা অনূর্ধ্ব-১৫ থেকে, ২০০৩ বা ২০০২ থেকে একসঙ্গে খেলছি। প্রায় ১৪-১৫ বছর হয়ে গেল। বোঝাপড়া তো একটু ভালো থাকেই। ওনার সঙ্গে এর আগে ওয়ানডে ও টেস্টে অনেকগুলো ভালো জুটি হয়েছে আমার। * দেশের পক্ষে টেস্টে সবচেয়ে বেশি রানের ইনিংস এখন আপনার। ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টিতেও নিশ্চয়ই সে রকম কিছু চাইবেন… সাকিব: ব্যক্তিগত অর্জনগুলোকে আমার কাছে ওরকম বড় কিছু মনে হয় না। আপনি অনেক দিন খেললে, ভালো খেলতে থাকলে সেগুলো এমনিতেই হয়ে যাবে। এগুলো চিন্তা করার বিষয় নয়। যারা চিন্তা করে, তারা টেনশনে একটু বেশি থাকে। আমার এগুলো নিয়ে চিন্তা নেই। * এ জন্যই কি মাঠে সব সময় নির্ভার মনে হয় আপনাকে? সাকিব: জানি না। এত দিন ধরে খেলছি। এখন তো একটু নির্ভার থাকাটা স্বাভাবিক। আর আমার কাছে মনে হয়, নির্ভার থাকলে আমি ভালো পারফর্ম করতে পারি। এ কারণে চেষ্টা করি নির্ভার থাকতে। তবে সব সময় নির্ভার থাকা সম্ভব হয় না। অনেক সময় অনেক চাপ চলে আসে। ম্যাচের মধ্যে, ম্যাচের আগে বা পরে। তখন চাইলেও নির্ভার থাকা যায় না। * নিউজিল্যান্ডের উইকেটে স্পিনারদের জন্য খুব একটা সুবিধা ছিল না। তারপরও বল হাতে আপনি মোটামুটি সফল। এটা কীভাবে সম্ভব হলো? সাকিব: সাফল্য পেলেও খুব যে ভালো বোলিং করেছি, তা নয়। উইকেট পেয়ে গেছি হয়তো ভাগ্য ভালো থাকায়। ওয়ানডেতে কিছুটা ভালো করেছি। টি-টোয়েন্টিতে এক ম্যাচে বাজে বল করেছি। উইকেট পেলেই ভালো বোলিং হয়, এটা ঠিক নয়। আগে যত ভালো বোলিং করতাম, অত ভালো বোলিং হয়তো আমি এখন করছি না। এটার অনেক কারণ থাকতে পারে। চোট, সবকিছু মিলিয়ে। * সে রকম কোনো চোট তো মনে হয় এখন আপনার নেই… সাকিব: না, চোট নেই। একসময় শিন বোনে অনেক ব্যথা ছিল। এ রকম হলে আপনার মনের অজান্তেই অনেক কিছু বদলে যাবে। আপনি নিজেই তা বুঝতে পারবেন না। * নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মোট আটটি ম্যাচ খেললেন। এর মধ্যে কয়টি বাংলাদেশের জেতা উচিত ছিল বলে মনে হয়? সাকিব: (হাসি) সবগুলোই তো জেতা উচিত ছিল। আসলে সীমিত ওভারের প্রায় সব ম্যাচেই আমরা জয়ের সুযোগ তৈরি করেছি। এমনকি টেস্টেও…। প্রথম টেস্টটা ড্র হওয়া উচিত ছিল। দ্বিতীয়টা ফিফটি-ফিফটি অবস্থায় ছিল, যেখান থেকে আমরা খুব বাজেভাবে হারলাম। * অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড মিলিয়ে দীর্ঘ এই সফরে দলে বেশ কিছু নতুন খেলোয়াড় ছিলেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের আবহের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সিনিয়র খেলোয়াড়েরা তাঁদের কীভাবে সাহায্য করেছেন? সাকিব: নতুন একটা খেলোয়াড় যদি ড্রেসিংরুমে স্বস্তি খুঁজে পায়, এর চেয়ে বড় আর পাওয়ার কিছু নেই। ওই আবহটা আমাদের দলের চেয়ে ভালো খুব কম দলেই আছে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.