বিজ্ঞানের বিস্ময়কর অগ্রযাত্রার স্পর্শহীন কিছু মানুষ বাস করে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বের গহীন পার্বত্য অঞ্চলে, যারা তাদের চিরাচরিত ঐতিহ্য এখনও অক্ষুণ্ন রেখেছে। সম্প্রতি কয়েক সপ্তাহ এই বান্দরবান জেলায়, লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা মানুষদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন আলোকচিত্রী রেহমান আসাদ। পার্বত্য অঞ্চলের গহীনে বাস করা মুরং জাতিগোষ্ঠির জীবনধারা, রীতিনীতি, বিশ্বাসগুলো তিনি অবলোকন করেছেন পরম বিস্ময়ে, আর ক্যামেরায় বন্দী করেছেন তাদের জীবনযাত্রা, উৎসবের কিছু খণ্ডচিত্র যা দেখলে আপনিও বুঝতে পারবেন তাদের জীবনধারা।
ঝুঁকিপূর্ণ অস্থায়ী সাঁকোতে পাহাড়ি ঝর্ণার পানি সংগ্রহে যাত্রা ।
পাঁচটি গ্রামে ঘুরে আসাদ দেখেছেন, ১১টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসবাস। যাদের মধ্যে মুরং একটি যা চতুর্থ বৃহত্তম গোষ্ঠী। তার আলোকচিত্রগুলো মূলতঃ মুরংদের জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। তারা মূলতঃ কৃষক, খাদ্য তালিকায় আছে ছাগল, শূকর, গরুসহ অন্যান্য প্রাণী। এমনকি বাঘের কথাও লিখেছেন আসাদ। এই মুরংদের জনপ্রিয় নাপ্পি তৈরি হয় মাছ, ব্যাঙ, হরিণ বা বন্য শূকরের গাঁজানো চর্বি ভাতের সঙ্গে মাখিয়ে।
কুমলাং উৎসবে বাঁশের বাঁশি বাজাচ্ছেন এক মুরং
তিনি এই নৃ-গোষ্ঠীর ‘কুমলাং’ উৎসব প্রত্যক্ষ করেছেন। ফসল উঠানোর আগ দিয়ে আয়োজিত বার্ষিক এই উৎসবে আগামী বছরের জন্য ফসলের সমৃদ্ধির প্রার্থনা করা হয়। আর এজন্য একটি গরু উৎসর্গ করে তারা। সেসময় তারা খায়, পান করে এবং নাচেগানে আনন্দ করে। ঘরে বানানো মদ খায় এবং বাঁশের বাশি বাজিয়ে উৎসবে সামিল হয়। নারীরা বর্ণিল ঐতিহ্যবাহী পোশাক ও গয়না পরে নাচে।
মাচাং ঘর
পার্বত্য চট্টগ্রামের গ্রীষ্মমন্ডলীয় বন এলাকায় প্রায় ২০০টি গ্রাম, যার একটিতে বাস করে মুরং গোষ্ঠির কেউ কেউ
এই উৎসবের প্রচলনের পেছনে যে উপকথা তাও চমকপ্রদ। মুরংদের পূর্বপুরুষরা মহাত্মা তোরাইকে (যাকে তারা মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা বিবেচনা করে ও পূজা করে) একটি গরু উপহার হিসেবে পাঠিয়েছিলো। অন্যান্য গোষ্ঠিগুলোর লিখিত ভাষা ও জীবনরীতি রয়েছে বুঝতে পেরে এ ব্যাপারে সহায়তা চেয়েই তাদের এই উপহার। তখন তোরাই কলাগাছের পাতায় এর নিয়মগুলো লিখে তাদের কাছে পাঠান। কিন্তু একটি শয়তান প্রাণী পাতাটি খেয়ে ফেললে ম্রুরা বঞ্চিতই রয়ে যায়। এই ঘটনার স্মরণেই প্রতিবছর একটি গরুকে উৎসর্গ করা হয়।
বিদ্যুৎ, আসবাবহীন বাড়ি
বাঁশের উপাদেয় খাদ্য তৈরিতে তাদের জুড়ি নেই
আসাদ জানান, পাহাড়ের চূড়ায় তাদের বাড়ি বাঁশ ও কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়, স্থানীয়ভাবে যা মাচাং ঘর নামে পরিচিত। প্রতিটি ঘরেই তিনটি বা তার বেশি কক্ষ রয়েছে এবং বাসার সামনে একটি ছোট বারান্দাও থাকে। এই কক্ষগুলো ঘুমানো, রান্না, স্টোররুম ও গেস্ট রুম হিসেবে ব্যবহার হয়। ঘরে বানানো একটি মাদুরেই তারা বাড়ির মেঝেতে পেতে ঘুমায়, পরিবারের সবাই একসঙ্গেই ঘুমায়। তাদের কোন আসবাবপত্র থাকে না, বিদ্যুৎ নেই। তবে কেউ কেউ ছোট সৌর প্যানেল ব্যবহার করে আলো জ্বালানোর জন্য।
অধিকাংশ মুরংই বৌদ্ধ। আবার কেউ কেউ ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান। তবে, তারা আধ্যাত্মবাদে বিশ্বাসী এবং ‘তুরাই’কে পূজা করে।
কুমলাং উৎসবকালীন সময় পানি জমিয়ে রাখছে বালিকারা
কুমলাং উৎসবের আয়োজন উপভোগের অপেক্ষায়
এই গোত্রের নারীরাই বেশি কাজ করে। পুরুষরা যেখানে শুধু পশু শিকার করে সেখানে নারীদের কাজ শুরু হয় সেই ভোর থেকে। পাহাড়ি ঝর্ণা, নদী বা হ্রদ থেকে ভোরেই তারা পানি সংগ্রহ করে এবং পরে রান্না করে। সকল গৃহস্থালি কাজও তারাই করে। তারা পাহাড়ে ফসল চাষ করে এবং কাঠও সংগ্রহ করে।
গ্রামের প্রান্তে এক শিশু
এখানকার শিশুরা প্রতিবেশীদের সাথে ঘরেই থাকে। তাদের জন্য কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায় তারা শিক্ষার আলো বঞ্চিত।
সূএ: ইন্টারনেট
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.