রাজু আহমেদ, কলামিষ্ট: বর্তমান সময় পর্যন্ত, সংসারের সবচেয়ে অবহেলায় কাটানো মানুষটি আমার শ্রদ্ধেয় বাবা, আমাদের পিতারা । পরিবারের সকল সদস্যের মুখে হাসি ধরে রাখতে তার ত্যাগ তাকে কখন যে যৌবন পেড়িয়ে বৃদ্ধের সীমায় গ্রাস করেছে তা বোধহয় তিনি টের পাননি । চোখের জ্যোতি কমেছে, নিকষ কালো চুলগুলো সব ধূসর সাদা হয়েছে, শরীর চামড়া ঝুলে গেছে অনেকটা, দেহের সবটা জুড়ে বয়সের ছাপ চরমভাবে ফুটে উঠেছে । তবুও তিনি সংসারের হাল ধরে আছেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নাবিকের মত । সেই শুরুর একটি মাত্র শার্ট আর দু’খানা লুঙ্গিতে তিনি কাটিয়ে দিলেন বছরের পর বছরের দিন-বহুদিন তবুও সন্তানের শরীরে কখনো জড়াতে দেননি পুড়ানো কোনকিছু । খেতে বসলেই ভালোর সবটুকু সন্তানের থালায় রেখে হাসিমুখে বলেছেন, ওর এখন শরীর গঠনের বয়স । একটু ভালো না খেলে কি করে চলে ? এই মানুষটি ঘুমের মধ্যেও চিন্তা করেছেন, কিসে সন্তানের মঙ্গল হবে । ……. আমাদের সমাজ ব্যবস্থার ধরণেই বাবার তেমন মুল্যায়ন নাই । অথচ আমাদের জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে নিভৃতে দেয়া তার অবদানে তাকে পূজ্য করে রাখা উচিত ছিল । বাবা যদি সন্তানের মত স্বার্থপর হতনে তবে কখন যে তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে যেত সব বন্ধন তার হিসাব কি করেছি কখনো ? বাবা উদাসীন থাকলে আমরা যে ভেসে যেতাম স্রোতের টানে । যে মানুষটি সেই সকাল থেকে ঘুমের পূর্ব পর্যন্ত অক্লান্ত পরিশ্রম করে সন্তানের ভবিষ্যত গড়ে দিয়ে যান সেই মানুষটি আমাদের পিতা । তিনি যদি মূহুর্তের জন্য ভোগবাদী এবং বিলাসী হতেন তবে সন্তানের জন্য অবশিষ্ট থাকতো না কোন সম্পদ কিংবা ব্যাংক-ব্যালেন্স । বাবারা প্রকাশ্যে খুব বেশি ভালোবাসা দেখাতে পারেন না বটে তবে তাদের হৃদয়ের সবটুকু জুড়ে সন্তানের প্রতি যে দরদ তা কি সন্তান হিসেবে কখনো উপলব্ধি করতে পেরেছি ? ……. বাবার ঋণ শোধ করার নয় । ভেবে দেখুন, আপনার জন্য সেই নিরীহ মানুষটি কতদিন ঝগড়া করেছে প্রতিবেশীর সাথে । শুধু আপনার ভবিষ্যত রঙিন করতে তিনি সম্পর্কচ্ছেদ ঘটিয়েছেন সকল আত্মীয়-স্বজনের সাথে । ত্যাগ করেছেন তার জীবনের সকল স্বাদ-আহ্লাদ শুধু আপনার শখ পূরণ করবেন বলে । অথচ এই মানুষটির সাথে আমরা দূরত্ব বাড়িয়ে চলেছি নিত্যদিন । দূরে অবস্থান করলে এবং টাকার প্রয়োজন হলে শুধু একটু কথা বলি । অথচ এই মহান মানুষটি আপনার হাসি মুখের জন্য বাড়ি ছেড়ে বহুদূরে গিয়ে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেছে শুধু আমাদেরকে নিশ্চিন্ত ও নিরাপদ রাখার জন্য । ……. সেই ছোটবেলা থেকে জেনে আসছিলাম আমার বাবা খুব কঠোর মনের মানুষ । কিন্তু এইচএসসি লেভেলে যেদিন প্রথম ঘর থেকে দূরের জন্য বের হলাম সেদিন বাবার কান্নামাখা মুখ, অশ্রুভেজা চোখ দেখেছিলাম । আমার অজান্তে যে মানুষটি সর্বদা আমার কল্যান কামনায় ব্যস্ত, যিনি প্রতিবেশির সাথে আমার প্রতিটি গুন বর্ণনা করে গর্ব অনুভব করেন তিনিও আমার বাবা । আজ অবধি, আমাকে বাবার টাকায় চলতে হয় । যখন যে প্রয়োজনে টাকা চেয়েছি, তিন চাহিদার পরিমানের এক টাকাও কম দেননি কোনদিন বরং বহু বেশি দিয়েছেন । শুধু আমার মঙ্গলের কথা ভেবে তিনি তার মঙ্গলের অনেক কিছু ত্যাগ করেছেন । সারা জীবন কাজ করেছেন শুধু আমার আগামীর নিরাপত্তার জন্য । এই বাবার ঋণ শোধ করবো কেমনে ? আমরা কি পারিনা, যাতে আমারা বাবা আমাদেরকে নিয়ে সবার কাছে গর্বভরে কথা বলতে পারেন, সম্মানের সাথে সমাজে চলতে পারেন তার ব্যবস্থা করে দিতে ? সুসন্তান হিসেবে এ দায়িত্বটুকু আমাদের পালন করা উচিত । …. আজ মে দিবসে সবচেয়ে শ্রদ্ধা পাওয়ার দাবীদার আমাদের বাবা । কেননা তার শ্রমেই বেড়ে উঠেছি আমি/আমরা । ভালো থাকুক আমাদের বাবারা, পৃথিবীর সকল ভালোর সংমিশ্রনে । আমার জন্য আমার জন্য যা করেছেন তার ছিঁটেফোঁটার ঋণ এ জীবনে শোধ করতে পারবো কিনা সন্দেহ তবে আমি যেন আমার বাবার ইচ্ছায় যে কোন স্বার্থে কোরবানী হতে পারি সে প্রার্থণা সর্বদা করি । সবার কাছে আমার/আমাদের বৃদ্ধ বাবার জন্য প্রার্থণা । বেঁচে থাকুক তারা অনন্তকাল জুড়ে এবং সুস্থ থাকুক দেহ-মনে ।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.