বিবিসি হিন্দির ফেসবুকের পাতায় আলোচিত সেই সাক্ষাৎকার। ছবি : ফেসবুক
রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। সাজানো গোছানো ভবনের একটি অংশে বসে আছেন কয়েকজন শিক্ষার্থী। এমন সময় সেখানে এলেন একটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের হিন্দি ভাষা শাখার একজন সাংবাদিক। সম্প্রতি দেশে ঘটে যাওয়া জঙ্গি হামলার সঙ্গে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ততা পাওয়ার পর সে বিষয়ে এখানকার শিক্ষার্থীদের বক্তব্য জানতে এসেছেন তিনি।
অন্য একটি ভাষার দেশে প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে সাধারণত তৃতীয় কোনো ভাষা বা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ভাষা ব্যবহার করা হয়। তবে একটি বাংলা ভাষাভাষী দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে ওই সাংবাদিক শুরু করলেন হিন্দি ভাষায় প্রশ্ন। এবং খুব সাবলীলভাবে হিন্দি ভাষায় সেসব প্রশ্নের উত্তর দিতে শুরু করলেন বাংলাদেশের ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। কেউ শুদ্ধ হিন্দিতে, কেউ হিন্দি আর ইংরেজি মিলিয়ে ওই সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তর দিলেন।
বিবিসি হিন্দির লাইভ অনুষ্ঠানে ধারণ করা এই ভিডিওচিত্রটি প্রকাশ করা হয়েছে সংবাদমাধ্যমটির অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে। গতকাল শনিবার ভিডিওটি প্রকাশের পর ফেসবুকজুড়ে ওঠে নিন্দার ঝড়। বেসরকারি ইউল্যাব বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব শিক্ষার্থীদের সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠেন নেটিজেনরা।
গতকাল থেকেই দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ফেসবুকে হিন্দিতে সাক্ষাৎকার দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে নিন্দা তিরস্কার করে মন্তব্য করছেন। অনেকেই আবার ইউল্যাবের শিক্ষার্থীদের ইংরেজি জ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। সেই সঙ্গে কিছুদিন আগে ভারতীয় একটি চ্যানেলকে দেওয়া তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর হিন্দি সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গ টেনে বিরূপ মন্তব্যও করছেন।
বিবিসি হিন্দির ফেসবুক পেজে গতকাল সাক্ষাৎকারটি প্রকাশের পর থেকেই বাংলাদেশের ফেসবুক ব্যবহারকারীরা সেটি শেয়ার দিয়ে এবং ওই ভিডিওর নিচে মন্তব্য করে নিন্দা জানাচ্ছেন।
ভিডিওটিতে দেখা যায়, বিবিসি হিন্দির সাংবাদিক ইউল্যাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ঢুকে হিন্দিতে বর্ণনা করছেন বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ের জঙ্গি ইস্যু সম্পর্কে। এরপর শিক্ষার্থীদের কাছে চলে যান আলোচনা করতে। তিনি শিক্ষার্থীদের হিন্দিতে প্রশ্ন করেন এবং শিক্ষার্থীরাও হিন্দিতে উত্তর দিতে শুরু করে। কীভাবে এত ভালো হিন্দি ভাষায় কথা বলতে পারছেন জানতে চাইলে ইউল্যাবের ওই শিক্ষার্থীরা জানান, টেলিভিশন দেখে দেখে তাঁরা হিন্দি শিখেছেন। তাঁদের বাসায় সারা দিন স্টার প্লাস, সনিসহ বিভিন্ন হিন্দি চ্যানেল চলে। তাঁদের মায়েরাও ভারতীয় চ্যানেলের ভক্ত বলে বিবিসি হিন্দিকে জানান তাঁরা।
এ ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে ফাহাদ খান নামে এক তরুণ নির্মাতা ফেসবুকে লিখেছেন, ‘তোরা বাংলা ভাষাকে গলা টিপে মাইরা ফেল। গলা টিপে না পারলে, হিন্দি ভাষায় গালি দিয়ে।’
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা লায়লা লিপি লিখেছেন, ’৫২-র ভাষা আন্দোলনের উদ্দেশ্য ২০১৬ সালে এসেও বোধগম্য না।’
শরীফ আহমেদ সাব্বির নামে একজন প্রশ্ন তুলেছেন, ‘বিবিসি হিন্দির সাংবাদিকরা যদি অন্য দেশে রিপোর্টিং করতে যান, তাহলেও কি তাঁরা হিন্দিতেই প্রশ্ন করেন?’
রুবায়েত সাইমম নামের এক ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন, “বিবিসি হিন্দি, বাংলাদেশের এক স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। তাঁরা প্রশ্ন করেছে হিন্দিতে। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন হিন্দিতে। ১০ জনের সাক্ষাৎকার নিয়েছে বিবিসি হিন্দি। ১০ জনই হিন্দিতে উত্তর দিয়েছেন। সেই ১০ জনের মাঝে একজনও বলেনি, ‘Can you please repeat the question in English?’ অথবা কেউ একবারও বাংলায় উত্তর দেয় নাই।
‘সমস্যা হিন্দিতে সাক্ষাৎকার দেওয়াতে না, সমস্যা হলো নিজের দেশের মাটিতে বসে নিজেকে ছোট ভাবাতে। আপনি হিন্দি জানতেই পারেন। কিন্তু যখন আপনি অন্য দেশের গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন তখন, আপনি আপনার দেশের প্রতিনিধি।”
কয়েকদিন আগে জঙ্গি ইস্যুতে একটি ভারতীয় চ্যানেলে হিন্দিতে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। সেই ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়লে অনেকেই এর সমালোচনা করেন। এখন আবার ইউল্যাবের শিক্ষার্থীদের দেওয়া সাক্ষাৎকার ঘিরে নতুন করে সেই বিতর্কও শুরু হয়েছে। অনেকেই তথ্যমন্ত্রীর প্রসঙ্গ টেনে মন্তব্য করছেন।
সুইডেনে অবস্থানরত বাংলাদেশি পিএচডি গবেষক প্রকৌশলী মাসুদ উর রশীদ লিখেছেন, ‘মাতৃভাষা বাদে একাধিক ভাষা শিক্ষা দোষের কিছু না, বরং তা এই বিশ্বায়নের যুগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারার সামর্থ্যের বহিঃপ্রকাশ। আর আপনি যে কোনো মাধ্যম ব্যবহার করেই তা শিখতে পারেন। এখন প্রশ্ন হলো, আপনি কোথায় সেই বিদেশি ভাষা ব্যবহার করবেন? আপনি আপনার ব্যবসায়িক কাজে অথবা অন্য যে কোনো নিজের প্রয়োজনে সেই ভাষাভাষি দেশের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে তা ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু আপনি যদি নিজের দেশে বসে নিজের দেশের কোনো বিষয় নিয়ে অন্য ভাষাভাষী দেশের কোনো সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন, তখন অবশ্যই মাতৃভাষাতেই কথা বলতে হবে, সেই দেশের ভাষাতে নয়। আর যখনই আপনি এর ব্যতিক্রম করবেন মনে রাখবেন তখনই আপনি নিজেকে একটা মেরুদণ্ডহীন ক্রমবর্ধমান গাছপাঁঠা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলেন, তা সে আপনি তথ্যমন্ত্রী হন আর বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীই হন।’
জাভেদ শাহ নামের এক প্রবাসী লিখেছেন, ‘১৫ বছর ধরে ঘরে ঘরে হিন্দি চ্যানেল চালানোর সুফল নিজের চোখে দেখে নেন। একদল তরুণ দেশের প্রতিনিধি হয়ে কীভাবে বাংলা, ইংরেজি বাদ দিয়ে কীভাবে হিন্দিতে কথা বলে এটা ভাবলে অনেক কষ্ট লাগে। এসব তরুণ সমাজের দোষ কী দেব, আমাদের সমাজের মূল শিকড়ই হচ্ছে যত নষ্টের গোড়া। এই তো কিছুদিন আগে দেখলাম একজন মন্ত্রীকে, দাদাদের খুশি করার জন্য ভুলভাল হিন্দিতে কথা বলছে ….’
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.