একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবেই। ওই নির্বাচনের পদ্ধতি বা ফলাফল যা-ই হোক না কেন, দলটি তার এ অবস্থানে শেষ পর্যন্ত অনড় থাকবে। কোনো অবস্থাতেই পিছু হটবে না। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নেয়ার মতো ভুল দ্বিতীয়বার আর করবে না। ওই সময় নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে দেশী ও বিদেশী যে চক্র দ্বিমুখী ভূমিকা রেখেছিল তারা আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। বড় লাভের আশা দেখিয়ে বিএনপিকে ফের নির্বাচন থেকে বাইরে রাখার তৎপরতা শুরু করেছে। সরকার যখন ভেতরে ভেতরে আগাম নির্বাচন দেয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে সে সময় চক্রটি বিএনপিকে এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার কুপরামর্শ দিচ্ছে। তবে দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে বৃহস্পতিবার সাফ জানিয়ে দেয়া হয়েছে, জাতীয় নির্বাচন যখনই হবে বিএনপি তাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেবে। এজন্য শুধু নির্বাচনী প্রস্তুতি ছাড়া ভিন্ন কোনো এজেন্ডা নিয়ে বিএনপি আর সময় ব্যয় করবে না। হাইকমান্ডের এমন মনোভাবের কথা দলের সব ধাপকে জানিয়ে দিতে বলা হয়েছে। দলটির নির্ভরযোগ্য সূত্রে গুরুত্বপূর্ণ এমন তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।
নাম প্রকাশ না করে বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের সূত্রটি যুগান্তর প্রতিবেদককে বলেন, দলটির হাইকমান্ড মনে করে- সরকারের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জনমনে যে ধারণা জন্ম নিয়েছে এবং যেভাবে ভেতরে ভেতরে বিএনপির ভোটব্যাংক তৈরি হয়েছে তাতে নির্বাচন নিয়ে বিএনপি খুবই আশাবাদী। এখন শুধু জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে যা যা করার বিএনপি সেদিকেই এগোবে। সেক্ষেত্রে ভোটের আগে দলটি শুধু নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়ে জোরালো ভূমিকা রাখার চেষ্টা করবে। তারপরও শেষ পর্যন্ত যে কমিশনই আসুক বিএনপি নির্বাচনের মাঠে থাকবে। কেননা দলটি মনে করে, নির্বাচনী প্রচারণার সময় ‘সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির’ বর্তমান চেহারা থাকবে না। অনেক কিছুই তখন পাল্টে যাবে।
সুশীল সমাজের প্রতিনিধি গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী শুক্রবার যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি মনে করি পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে এবং নির্বাচনমুখী দল হিসেবে বিএনপির নির্বাচনে যাওয়া উচিত। তবে তার আগে তাদের শক্তিশালী নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন এবং সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য দেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করা উচিত।’
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচনের আগে বিএনপি সরকারবিরোধী আন্দোলন করার মতো কোনো ফাঁদেও আর পা দেবে না। কারণ হিসেবে তিনি মনে করেন, নির্বাচনে জেতার জন্য এখন আর সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার প্রয়োজন নেই। এক সময় এটির প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের পুরো রাজনীতি চিত্র আওয়ামী লীগ বদলে দিয়েছে। এখন আর বিএনপিকে আন্দোলন করতে হবে না। অনেক স্থানে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগকে দেখা যাবে। এছাড়া অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে জনগণই সঠিক জবাব দেবে। তাই ভোটের আগে তারা আর কোনো শক্তি ক্ষয় করবে না, সব শক্তি নিয়ে বিএনপি ভোটের মাঠে সক্রিয় হবে।
দলটির এ ঘরানার অপর একজন নীতিনির্ধারক বলেন, আগামী নির্বাচনে প্রার্থীর চেয়ে দলীয় প্রতীক বেশি প্রাধান্য পাবে। যেমনটি হয়েছিল ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে। সে সময় বিএনপি ও ওয়ান-ইলেভেন সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষ এতটাই ক্ষুব্ধ ছিল যে, সাধারণ জনগণের ক্ষোভে ভোটে আওয়ামী লীগের অনেক সাধারণ প্রার্থীও বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। ওই সময় আওয়ামী লীগের জয় নিশ্চিত করতে সেনা সমর্থিত সরকার যে ব্লুপ্রিন্ট করেছিল শেষ পর্যন্ত তা আর সেভাবে প্রয়োজন হয়নি। তিনি মনে করেন, পরবর্তী নির্বাচনেও এমন একটি পরিস্থিতি সবার জন্য অপেক্ষা করছে। সেজন্য বিএনপি এখন চায়, দেশী ও বিদেশী সব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে নির্বাচন পর্যন্ত চুপচাপ থাকতে। কেননা মহলবিশেষ ঘৃণিত স্বার্থে নির্বাচনের আগে দেশকে জঙ্গিবাদের তকমা দিয়ে ভয়াবহ খারাপ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিতে চায়। কিন্তু বিএনপি তা চায় না। বিএনপি এখন চায়, সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অধীনেই নির্বাচন করতে। এতে দুটো লাভ হবে। প্রথমত, দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা শক্তিশালী ভিত পাবে, বিপরীতে বিএনপিও সংকট কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে। যদি সরকারের দমনপীড়ন ও বিভিন্ন অপশক্তির সমর্থন নিয়ে ফের আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় চেপে বসে তাতেও বিএনপির বড় কোনো ক্ষতি হবে না। কেননা সে রকম কিছু হলেও বিএনপি সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে।
সূত্রটি জানায়, সংবিধান অনুযায়ী ২০১৯ সালের অনিবার্য জাতীয় নির্বাচন ছাড়াও বিএনপি এখন আগাম নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে চায়। কেননা, কৌশলী রাজনীতির অংশ হিসেবে সরকারি দল ‘পেট্রলবোমা রাজনীতি’র মামলায় বিএনপির হাইপ্রোফাইলের একটি বড় অংশকে সাজা দেয়ার পর আগাম নির্বাচনের ঘোষণা দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে এ রকম ঘোষণা আগামী ডিসেম্বর ও জানুয়ারি নাগাদ আসার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই নির্বাচনের মাঠে প্রার্থী বাছাইয়ে একাধিক বিকল্প টায়ার বা ধাপ প্রস্তুত রাখার জন্য এ সপ্তাহ থেকে কাজ শুরু করবে বিএনপির নীতিনির্ধারক মহল। এ বিষয়ে দলটির প্রাথমিক কাজ কয়েক মাস আগেই শেষ করা আছে। এখন তা চূড়ান্ত রূপ দেয়া হবে।
এ পরিকল্পনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন দায়িত্বশীল নেতা জানান, প্রার্থী বাছাইয়ে চূড়ান্ত রূপ দিতে বিএনপি দুটি ফর্মুলাকে সামনে নিয়ে কাজ করবে। প্রথমত. বিএনপির সম্ভাব্য যেসব প্রার্থীকে সরকার নানাভাবে নির্বাচন থেকে বাইরে রাখার চেষ্টা করবে সেখানে এখন থেকেই কয়েকটি ধাপে বিকল্প প্রার্থী প্রস্তুত করা। দ্বিতীয়ত. যেখানে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কাছে বিএনপির প্রার্থীর পরাজয়ের শংকা থাকবে সেখানে বিকল্প শক্তিশালী প্রার্থী বাছাই করা। তবে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত এ সংক্রান্ত তালিকা কঠোরভাবে গোপন রাখা হবে। এটি একমাত্র হাইকমান্ডের তত্ত্বাবধান ও সংরক্ষণে থাকবে। তিনি জানান, আগামী নির্বাচনে বিএনপিতে অনেক নতুন মুখও দেখা যাবে। সমাজের কাছে অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য হিসেবে যারা সুপরিচিত; কিন্তু রাজনীতি করেন না, এমন অনেক ব্যক্তির হাতে ধানের শীষের প্রতীক তুলে দেয়া হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
এদিকে দলীয় অপর একটি সূত্র জানায়, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে বিএনপির একটি খণ্ডিত অংশকে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ভাগিয়ে নিতে পারে। সে ব্যাপারেও দলের হাইকমান্ড সতর্ক রয়েছে। সন্দেহভাজন নেতাদের গতিবিধির ওপর নজর রাখা হচ্ছে। ইতিমধ্যে এ তালিকার কয়েকজন প্রভাবশালী নেতাকে ঘোষিত কমিটিতে ডাম্পিং জোন হিসেবে পরিচিত ‘চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদসহ গুরুত্বহীন’ পদ দিয়ে রাখা হয়েছে। এসব নেতার বিরুদ্ধে সরকারি দলের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ রাখার অকাট্য প্রমাণও দলটির সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.