বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নিহত ও আহতরা -ফাইল ফটো
২১ আগস্ট ঢাকায় আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলায় বেঁচে যাওয়া নেতাকর্মীরা আজও ভয়ে আঁতকে ওঠেন। রাতে ঘুমোতে গিয়ে চোখ বুজলেই কানের কাছে ‘বাঁচাও, বাঁচাও’ শব্দ ভেসে আসে। বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলা তাদের আজও তাড়া করে। বেঁচে যাওয়া অধিকাংশ নেতাকর্মীর শরীরে মরণ ব্যাধি ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছে। এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচার আজও হয়নি। কোনোভাবেই তা মেনে নিতে পারছেন না আহত ও নিহতদের পরিবারের সদস্যরা। গ্রেনেডের স্পিন্টার গেঁথে যাওয়া শরীরে আমৃত্যু যন্ত্রণা নিয়ে তাদের একটাই কামনা, হামলার সঙ্গে জড়িতদের অন্তত শাস্তি হোক। সেদিনের হামলার শিকার কয়েক নেতাকর্মীর কষ্টের বর্ণনা এখানে তুলে ধরা হল-
রফিকুল ইসলাম ওরফে আদা চাচা : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলতে এক প্রকার পাগলই ছিলেন রফিকুল ইসলাম ওরফে আদা চাচা। প্রতি মাসেই ৫/৭ কেজি আদা কিনে বিশেষ পদ্ধতিতে ঝাঁজ কমিয়ে ভিন্ন এক স্বাদে শুকনো আদার টুকরো বানাতেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ নেতাকর্মী তথা সহযোদ্ধাদের এ ভিন্ন স্বাদের আদা খাওয়াতেন। খোদ প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের প্রায় সব নেতাকর্মী তাকে ‘আদা চাচা’ বলেই ডাকতেন। সেই ২১ আগস্টও পলিথিন ভরে শুকনো আদা নিয়ে জনসভাস্থলে হাজির ছিলেন আদা চাচা। মঞ্চের পাশেই ছিলেন তিনি, এক এক করে আদা দিচ্ছিলেন নেতাকর্মীদের হাতে। চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের গ্রেনেড হামলায় ওইদিন আদা চাচারও করুণ মৃত্যু হয়। শনিবার আদা চাচার খিলগাঁওয়ের সিপাহীবাগের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, তার ছেলেরা পরিবারের সদস্যদের বাবার গল্প শোনাচ্ছেন। ৫ ছেলে ৩ মেয়ের পরিবারে এখন ২৫ সদস্য। টিনশেডের তিনটি রুমে গাদাগাদি করে সবাই থাকেন।
রাশেদা আক্তার রুমা : ২১ আগস্ট শেখ হাসিনা যে ট্রাকে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিচ্ছিলেন সেই ট্রাকের পেছনে ছিলেন রাশেদা আক্তার রুমা। বর্তমানে শরীরে ক্যান্সার নিয়ে বসবাস করছেন পুরান ঢাকার মাজেদ সরদার রোড এলাকায়। শুক্রবার তার বাসায় গিয়ে কথা হয়। রুমা জানালেন, এখনও শরীরে প্রায় ১৬/১৭শ’ স্পিন্টার রয়েছে। গ্রেনেডের আঘাতে ১৮টি দাঁত পড়ে গেছে। কোমর থেকে পা পর্যন্ত এখনও অবশ। পায়ে পচন লেগেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া অর্থ সহযোগিতায় চিকিৎসা চালাচ্ছেন তিনি।
মাহবুবা পারভীন : গ্রেনেড হামলার পর মাহবুবা পারভীনকে ঢামেক হাসপাতালে নেয়া হয়। তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়েছিল। রাখা হয়েছিল অন্যসব লাশের সঙ্গে। কিন্তু ওই সময় নেতাকর্মীদের তৎপরতায় তাকে আবার চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হলে দেখতে পান তার শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে। শনিবার কথা হয় মাহবুবা পারভীনের সঙ্গে। জানালেন, এখনও শরীরে প্রায় ১৮শ’ স্পিন্টার নিয়ে বেঁচে আছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে আর্থিক সহযোগিতাসহ অনেক পেয়েছেন স্বীকার করে তিনি বলেন, বর্তমানে তার ডান হাত, পা থেকে শুরু করে এক পাশ অবশ হয়ে গেছে।
আসমা জেরিন ঝুমু : আসমা জেরিন ঝুমু এখনও কোমর আর পায়ের ব্যথায় প্রায় ভুগছেন। মন থেকে কিছুতেই মুছতে পারছেন না সেই দিনের বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলার ভয়াবহ দৃশ্য। শুক্রবার বিকালে রাজধানীর মালিবাগ এলাকায় তার বাসায় গিয়ে দেখা যায় হাঁটুর নিচ থেকে পায়ের তলায় বিদ্ধ স্পিন্টারগুলো হাত দিয়ে ধরে ধরে দেখছিলেন। তাকে কলকাতার পেয়ারলেস হাসপাতালে পাঠানো হয়। তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় এখনও অসংখ্য স্পিন্টার রয়ে গেছে।
নাসিমা ফেরদৌসী এমপি : সংসদ সদস্য নাসিমা ফেরদৌসীর পুরো শরীরে স্পিন্টার বিধে রয়েছে। ঘুমোতে গেলেই দম আটকে আসে যন্ত্রণার ভারে। শ্বাস নিতে কষ্ঠ হয়। বলেন, ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারের সদস্যদের যারা হত্যা করেছে তাদের নিয়েই বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে মারতে চেয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী এখনও নিজস্ব তহবিল থেকে আহত ও নিহতদের পরিবারের সদস্যদের সার্বিক সহযোগিতা করছেন।
ডা. লুৎফুননেছা সোনালী : মহিলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদিকা ডা. লুৎফুননেছা সোনালী প্রতিনিয়ত স্পিন্টারের যন্ত্রণায় ভোগেন। স্পিন্টার থেকে তার ক্যান্সারের সৃষ্টি হয়েছে। মাথায় শতাধিক স্পিন্টার বিদ্ধ হওয়ায় তিনি প্রায় স্মৃতি হারিয়ে ফেলেন। বুকের এক পাশে ক্যান্সারের অপারেশন হয়েছে। এখন অপর পাশে দেখা দিচ্ছে সেই লক্ষণ। হামলার পর ২৭ দিন অজ্ঞান ছিলেন। শেখ হাসিনা চিকিৎসার জন্য তাকে ভারতের পিয়ারলেস হাসপাতালে পাঠান। দেড় মাস চিকিৎসা শেষে ওখানকার ডাক্তাররা বলছিলেন তার ডান হাত ও পা কেটে ফেলতে। কিন্তু, ওই সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রচণ্ড প্রতিবাদে পা-হাত কাটা হয়নি তার।
অঞ্জলী সরকার : প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক ও বিভিন্ন সহযোগিতা না পেলে কবেই মরে যেতেন জানিয়ে অঞ্জলী সরকার বলেন, যে করেই হোক বর্তমান সরকারের আমলেই যেন ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে জড়িত ও নির্দেশদাতাদের বিচার করা হয়।
সাহিদা তারেক দীপ্তি : ঘাতকরা শারীরিকভাবে তাকে পঙ্গু করলেও তার মানসিক শক্তি এখনও অটুট বলে জানিয়েছেন সাহিদা তারেক দীপ্তি। বলেন, মাথায় স্পিন্টার থাকায় এখন অনেক কিছুই ভুলে যান। ভারত, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডে চিকিৎসা করার পর হাঁটতে পারেন।
জালাল উদ্দিন : রাজধানীর মাদারটেক বাজার এলাকায় থাকেন। জালাল উদ্দিন জানান, প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতায় তিনি চিকিৎসা করছেন, এখনও প্রতি মাসে টাকা পাচ্ছেন। স্পিন্টারের তীব্র ব্যথায় টানা কাঁদেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট অফিস সূত্রে জানা যায়, ট্রাস্টের মাধ্যমে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় আহত প্রায় ৫শ’ নেতাকর্মীকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। প্রায় ৩শ’ নেতাকর্মীকে ৩ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত দেয়া হয়েছে। প্রতি মাসে ১০৭ জনকে ৫ হাজার টাকা করে দেয়া হচ্ছে। এছাড়া গ্রেনেড হামলায় আহত নেতাকর্মীদের প্রায় দুই হাজার সন্তানকে ২ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা করে প্রতি মাসে বৃত্তি দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, ট্রাস্টের চেয়ারপারসন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আহত প্রত্যেককে ব্যক্তিগতভাবে খোঁজখবর নিচ্ছেন।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.