খেলাপি ঋণের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। অব্যবস্থাপনা ও ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের কারণে প্রতি মাসেই অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে চলেছে খেলাপির অংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ বেড়েছে। ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ পরিস্থিতি ব্যাংকিং খাতের জন্য অশনিসংকেত। এতে ব্যাংকিং শৃংখলা আরও ভেঙে পড়তে পারে। তারা আরও বলেছেন, কিছু ব্যাংকের চেয়ারম্যান, পরিচালক ও এমডিরা দুর্নীতিবাজ। এদের যোগসাজশে ঋণ দেয়া হয়। যার কারণে ঋণ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে খেলাপিতে রূপ নিচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ব্যাংক খাতে জুন পর্যন্ত ঋণের স্থিতি ৬ লাখ ৩০ হাজার ১৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৬৩ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা। যা মোট ঋণ বিতরণের ১০ দশমিক ০৬ শতাংশ। গত মার্চ প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ ছিল ৫৯ হাজার ৪১১ কোটি টাকা। সে হিসাবে তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতেই। জুন প্রান্তিকে সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী, বিডিবিএল ও বেসিক ব্যাংকে ঋণ খেলাপি হয়েছে ৩০ হাজার ৭৭ কোটি টাকা। যা বিতরণ করা ঋণের ২৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, এটা ব্যাংক খাতের জন্য অশনিসংকেত। এভাবে খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকলে সুদের হার কমানো যাবে না। আর সুদের হার কমাতে না পারলে বিনিয়োগ বাড়বে না। তিনি বলেন, অপাত্রে ঋণ দেয়া হচ্ছে। ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই হচ্ছে না। বিশেষ করে সরকারি ব্যাংকগুলোতে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এভাবে চলতে থাকলে ব্যাংকিং শৃংখলা ভেঙে পড়ার আশংকা করেন তিনি।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংক খাতের বড় সমস্যা খেলাপি ঋণ। আর এ সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে দুর্নীতির মাধ্যমে ঋণ দেয়ার কারণে। কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়া রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ দেয়া হয়। এটা বেশি চলে সরকারি ব্যাংকে। এর জন্য দায়ী অর্থ মন্ত্রণালয়। কারণ সরকারি ব্যাংকে ভালো লোক নিয়োগ দেয়া হয় না। বিশেষ করে ব্যাংকের চেয়ারম্যান, পরিচালক ও এমডিরা দুর্নীতিবাজ। এদের যোগসাজশে ঋণ দেয়া হয়। পরে সে ঋণ আর উত্তোলন হয় না। তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ আরও বাড়বে। বিগত বছরগুলোতে যেসব ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে সেগুলোই আবার খেলাপি হচ্ছে। এটি সমাধানের কোনো উদ্যোগ নেই।
বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে ঋণ খেলাপি হয়েছে ২৫ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। যা বিতরণ করা ঋণের ৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ। আর বিদেশী ব্যাংকগুলোর ঋণ খেলাপি হয়েছে ২ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা। যা বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ। সরকারি বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ঋণ খেলাপি হয়েছে ৫ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা। যা বিতরণ করা ঋণের ১৬ দশমিক ১৪ শতাংশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. এমএ তসলিম যুগান্তরকে বলেন, দেশের আর্থিক পরিস্থিতি ভালো না। এখানে যারা কারিগর আছেন তাদের বেশিরভাগই আদিষ্ট। সে কারণে আর্থিক খাতে ব্যাপক অনিয়ম হচ্ছে। সুশাসনের অনেক অভাব। এসব কারণে খেলাপি ঋণ বেড়ে থাকতে পারে।
জানা গেছে, আগের প্রান্তিক মার্চের তুলনায় বর্তমান জুন প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। তিন মাস আগে মার্চ প্রান্তিকে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। এ ছাড়া বিপুল পরিমাণের এই খেলাপির সঙ্গে ঋণ অবলোপন যোগ করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। কারণ বর্তমানে ব্যাংক খাতে ঋণ অবলোপনের পরিমাণ প্রায় ৪১ হাজার কোটি টাকার বেশি। পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল হালিম চৌধুরী মঙ্গলবার রাতে যুগান্তরকে বলেন, দুই কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। পুনঃতফসিল করা বেশিরভাগ ঋণ আবার খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে। এ ছাড়া গত বছরের শুরুতে রাজনৈতিক অস্থিরতায় ব্যাংকিং কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছিল। এসব কারণে বিনিয়োগে এক ধরনের স্থবিরতা নেমে আসে। তারই প্রতিফল হচ্ছে খেলাপি ঋণ।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.