তখন রাত সাড়ে ১১ টা বাজে সিঙ্গাপুর .আমি বাড়িতে ফোন করতে ছিলাম এমন সময় দেখলাম পাশে একজন লোক অনেক ক্ষন ধরে আকাশে তাকিয়ে আছে.মনে মনে ভাবলাম লোক টার কি হয়েছে যে এভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে.কিছুক্ষন পর আবার তাকালাম, লোকটা আগের মতই আছে.ফোনের লাইনটা কেটে লোকটার কাছে গেলাম। আমি =জিজ্ঞাসা করলাম দেশী ভাই নাকি লোকটি = বললেন হ্যা আমি=ভাই অনেক ক্ষন ধরে দেখলাম আপনি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন যে? লোকটি =এইতো ভাই হিসাব করতেছিলাম এই প্রবাসে জীবনে কি পেলাম আর কি হারালাম আর ২১ বছরের প্রবাস জীবনের দুঃখগুলো ভাবতে ছিলাম! আমি ২১ বছরে কথা শুনে অভাগ.খুব কৌতুহলী হয়ে বললাম ভাই আমাকে বলবেন আপনার দুঃখ গুলো? আমার খুব শুনতে ইচ্ছে কর করছে. লোকটি =ভাই ২১ বছরে দুঃখগুলো মাত্র কয়েক মিনিটে শুনে কি করবেন. আমি =ভাই আমি হয়ত পারবোনা আপনার দুঃখগুলো তাড়িয়ে দিতে ,কিন্ত এমনতো হতে পারে যে, আপনার দুঃখগুলো শুনে আমি কিছু শিক্ষা নিতে পারবো, কারণ আমি ও তো একজন প্রবাসী. লোকটি =তাহলে শুনেন, আমরা ছিলাম ৬ ভাইবোন আমি ছিলাম সবার বড়.বাবা ছিলেন কৃষক নিজেদের জমি চাষ করতাম, বাবার সাথে আমি কাজ করতাম.বাপ বেটা মিলে সংসারে অভাব দূর করতে পারতাম না ..ছোট ভাইবোন‘রা পড়ালেখা করতো, ওদের কাউকে ক্ষেতে–খামারে নিতাম না, যদি পড়ালেখার ক্ষতি হয়। এভাবে দিনের পর দিন কষ্ট করতে লাগলাম, কিন্তূ কষ্টের দিন শেষ হয় না,একদিন কিছু জায়গা বিক্রি করে পাড়ি দিলাম ইরাক, সেখানে চার বছর ছিলাম, তারপর বাড়িতে আসলাম,এর মাঝে সংসারে অভাব কিছুটা দূর হলো, ভাইবোনদের পড়ালেখা ভালো চলছিল.কিছুদিন যাবার পর দেখালাম আবার ও পুরানো দুঃখগুলো বাড়ির চারপাশে ঘুরতেছে, আবার পারি দিলাম সিঙ্গাপুর, সিঙ্গাপুর এসে মাত্র কয়েক মাস থাকার পর পারমিট বাতিল করে দিল,দেশে গিয়ে পরলাম মহাবিপদে যা টাকা ছিল সব শেষ! মা বাবা বললেন বিয়ে করতে ,আমি বিয়ে করিনি, কারণ ভাইবোন গুলো পড়ালেখা শেষ করে চাকরি পাক আবার বোনদের বিয়ে দেওয়া হয় নাই! কয়েক বছর পর আবার আসলাম সিঙ্গাপুর…এর মাঝে কেটে গেল অনেক বছর,ছুটিতে বাড়ি গেলাম বিয়ে করব বলে কিন্ত বিয়ে করতে গিয়ে পড়লাম অনেক জামেলায়, বয়স বেশি আর অশিক্ষিত বলে ভাল বাড়িতে বিয়ে করতে পারলাম না.শেষে কোনো উপায় না পেয়ে গরিবের এক মেয়েকে বিয়ে করলাম, তাও আবার আমার থেকে অর্ধেক বয়সের! জীবনে খুঁজে পেলাম সুখের ঠিকানা, ভালোই কাটছিলো ছুটির দিনগুলো মনে হইছিল পৃথিবীতে আমি একজন সুখী মানুষ।
ছুটি শেষ করে আবার চলে আসলাম সিঙ্গাপুর.সিঙ্গাপুর এসে কোনো কিছু ভালো লাগতো না! রাতে ঘুম আসেনা! কাজে মন বসে না! বাড়ি যাওয়ার জন্য মনটা ছটফট করতো! মনে মনে ভাবলাম ভাইবোনদের বিয়ে হয়ছে ভালো চাকরি হয়েছে ভাইদের, এখন আমার দায়িত্ব শেষ এই ভেবে একেবারে বাড়ি চলে গেলাম। আর এটাই ছিল আমার জীবনে সবচেয়ে বড় ভুল! এখন সেই ভুলের মাসুল দিতেছি.কিছু দিন যাওয়ার পর দেখালাম চেনা মানুষ গুলো অচেনা হয়ে গেলো! যে মা বাবা ভাই বোনদের জন্য এত কষ্ট করলাম! তারা যেন আমাকে চিনে না! কারণ আমি কেন একেবারে. চলে এলাম দেশে.আর বুঝতে পারলাম এতদিন ওরা আমাকে ভালোবাসেনি, ভালবাসতো আমার টাকাকে! আর মা বাবা আমার কথা শুনতোনা! ভাইদের কথা শুনতো! কারণ ওরা মা বাবাকে বেশি যত্ন করতো বলে.মা আর আমার বৌয়ের সাথে প্রতিদিন লেগে থাকতো জগড়া! মা বলতো আমি বৌয়ের কথা শুনি! আর বউ বলতো মায়ের কথা“ এদিকে বৌয়ের সাথে আমার সম্পর্ক ভালো না! বৌয়ের যেটা ভালো লাগে আবার আমার সেটা ভালো লাগেনা. বৌয়ের কোনো দোষ নাই,আসলে ভাই জীবনে যৌবনের তরীটা যে সময় ভাসানো দরকার ছিল, সেই সময় ভাসাইনি,অসময়ে ভাসাইছি ঠিকই কিন্ত যৌবনের তরীটা আজ বাইতে পারি না! মাঝে মাঝে এত কষ্ট লাগে যাদের জন্য এত কষ্ট করলাম আজ তারা কত সুখে, আর আমি একাই কত কষ্টে আছি! আজ ভ্যাগের কঠিন আঘাতে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে আমার দেহ মন! ভ্যাগের কঠিন নিয়মে পরাজিত হয়ে দিক–বিদিক হারিয়ে ফেলেছি! যে না পাওয়াটার জন্য এত কষ্ট করলাম আজ তা পেয়ে হারালাম!!! কিছু নিজের স্বার্থপর আপনজন কারণে! “অভাবের দিন যে কত বড় তা শুধু অভাবে যারা থাকে তারা বুঝে“ আবার টাকা ঋণ করে সিঙ্গাপুর আসলাম, ঋণের তাড়নায় কোনো কিছু ভালো লাগে না.একদিন ভাইকে ফোন দিয়েছিলাম বললাম আমাকে এক লক্ষ টাকা ধার দে.সে যে কথা বলছে আমি কোনো দিন ভুলতে পারব না.আমাকে বলল,এক বেলা না খেয়ে থাকলে এক বেলা খাওয়ানো যায় ,বা ১শ টাকা 1হাজার টাকা ধার দেওয়া যায় .কারো ঋণ শোধ করা যায়না!!! মাঝে মাঝে ইচ্ছে করতো মরে যাই! কিন্ত আমার একটি ছেলে আছে তার কি হবে? মা বাবা ভাই বোন সবাই সুখে আছে হয়তো বউও চলে যাবে! কিন্ত আমার ছেলে কি হবে?ভাইদের অনাদর অবহেলায় বড় হবে .তাই আবার নতুন করে যুদ্ধ শুরু করলাম শেষ বয়সে………!!!
কথাগুলো বলতে বলতে দেশী ভাইটি কাঁদছিল.আমি ও তার কথা শুনতে শুনতে কখন যে কাঁদতে ছিলাম আমি নিজে বুঝতে পারিনি! দেশী ভাই কে কি বলে সান্তনা দেবো আমার সব ভাষা হারিয়ে ফেলছিলাম.শুধু বললাম, আমরা প্রবাসীরা হলাম এমন এক যুদ্ধের সৈনিক. যে যুদ্ধের জয়ের উল্লাস আমরা করতে পারি না! দিয়ে দিতে হয় অন্যদের …হয়তো অন্যদের মাঝ থেকে জয়ের উল্লাস কেউ পায় আবার কেউ পায় না.অথচ, এই যুদ্ধে আমাদের দিতে হয় পরিশ্রম নামে জীবনের স্বাদ ইচ্ছা ভালো লাগার মুহূর্তগুলোকে বিসর্জন!!!
জানি না আমার এই লেখাটা কয়জন প্রবাসী পড়বে.যদি একজন প্রবাসী ভাই পড়েন .তাকে বলব যতদিন প্রবাসে থাকবেন কিছু টাকা সঞ্চয় করুন, আমরা সারা বছর দেশে টাকা পাঠালে ও বাড়ির অভাব দূর করতে পারব না……
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.