বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের বাইরে বেসরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তিনটি প্রধান বাধা রয়েছে বলে মনে করছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।
এগুলো হল- জ্বালানি অবকাঠামো, সম্পদের (জমির) মালিকানার স্বত্ব নিয়ে জটিলতা এবং পোশাক শিল্পের বাইরে অন্য শিল্পোদোক্তাদের ব্যক্তি উদ্ভাবনী সক্ষমতার অভাব।
বলা হয়েছে- বাংলাদেশের কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি অর্জনে দক্ষ জনশক্তি ও অর্থনৈতিক বহুমুখীকরণ প্রয়োজন। বর্তমানে পোশাক শিল্পের মধ্যবর্তী ব্যবস্থাপক হিসেবে বহু বিদেশী শ্রমিক কাজ করছেন। দক্ষ জনশক্তি থাকলে বাংলাদেশী শ্রমিকরাই অধিক বেতনে চাকরি করতে পারতেন। বর্তমানে যে পরিমাণ মানুষ কর্মের বাজারে প্রবেশ করছে তাদের কর্ম দিতে হলে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে।
সংস্থাটির বাংলাদেশ কান্ট্রি ডায়াগনস্টিক স্টাডি : কনসোলিডেটিং এক্সপোর্ট-লেড গ্রোথ এবং ইম্পলয়মেন্ট ডায়াগনস্টিক স্টাডি : লুকিং বেয়ন্ড গার্মেন্ট শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
বৃস্পতিবার রাজধানীর রেডিসন হোটেলে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এ প্রতিবেদন দুটি প্রকাশ করা হয়। অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন এডিবির বাংলাদেশ মিশনের আবাসিক প্রধান কাজুহিকো হিগুচি, পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম এবং প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব বেগম শামসুন নাহার।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এডিবির সিনিয়র ইকোনমিস্ট ভেলিরি মেরসার ব্লাকম্যান ও লিড রিসার্স কন্সালটেন্ড রিজওয়ানুল ইসলাম। বক্তব্য রাখেন- আইএলওয়ের কান্ট্রি ডাইরেক্টর শ্রীনিবাস রেড্ডি বাকি, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের যুগ্ম সচিব বেগম ফাতেমা ইয়াসমিন প্রমুখ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উচ্চ কিন্তু এটি আরও বাড়াতে মানসম্মত বিনিয়োগ প্রয়োজন। প্রবৃদ্ধি গত দুই শতাব্দীর মধ্যে ৫-৬ শতাংশে রয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যে লক্ষ্য অনুযায়ী মধ্যআয়ের দেশে যেতে হলে ৭.৫ থেকে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। কিন্তু এ স্টাডিতে বেশকিছু বাধা চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমন অপর্যাপ্ত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ, তৈরি পোশাক খাতে শিল্প পলিসির ঘাটতি এবং জমি রেজিস্ট্রি সংক্রান্ত জটিলতা ও জমির মালিকানা স্বত্ত্ব এবং সম্পদের নিরাপত্তা অন্যতম। প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে এসব বাধা দূর করতে হবে।
এছাড়া মানসম্মত শিক্ষা ও দক্ষতা বাড়াতে হবে। অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় বৃদ্ধি এবং করের আওতা বাড়িয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের জন্য ফান্ড দিতে হবে। বলা হয়েছে, বাংলাদেশে দারিদ্র্য দ্রুত হারে কমছে। ২০০০ সালে যেখানে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪৯ শতাংশ, সেখানে ২০১৬ সালে এসে কমে দাঁড়িয়েছে ২৪ শতাংশে। এর অন্যমত কারণ হচ্ছে নিুআয়ের মানুষের মধ্যে অর্থ প্রাপ্তি সহজ হয়েছে এবং সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচির সুফল।
তাছাড়া বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ঋণে ভালো করায় অর্থ প্রাপ্তি সহজ হয়েছে এবং মোবাইল প্রযুক্তির বিকাশ ঘটায় মানুষের জীবনযাত্রার মধ্যে পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশকে মধ্যআয়ের দেশে যেতে হলে অর্থনৈতিক বহুমাত্রিকতা আনতে হবে। এক্ষেত্রে পোশাক শিল্পের পাশাপাশি অন্যান্য শিল্পপণ্য রফতানি বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে ওষুধ, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষিজাত পণ্য,পাট ও পাটজাত পণ্য, প্লাস্টিক পণ্যসহ বিভিন্ন পণ্য রফতানি বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে।
এছাড়া পর্যটনে উন্নতি করার সুযোগ রয়েছে। বলা হয়েছে অবকাঠামো উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক বহুমুখীকরণ করা গেলে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি বাড়বে। সেই সঙ্গে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে এবং মধ্যআয়ের দেশে যাওয়া সহজ হবে। এক্ষেত্রে ভোকেশনাল শিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করে পোশাক খাতের দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে শ্রমিক রফতানি বাড়ানো যেতে পারে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, অর্র্থনৈতিক বহুমাত্রিকতা আনতে সরকারকে অন্য শিল্পের বাধাগুলো খুঁজে বের করতে হবে। পোশাক শিল্পের বাইরে পণ্য রফতানি বাড়াতে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
বিদেশী বিনিয়োগ এবং রফতানি বাড়াতে বেসরকারি খাতকে উৎসাহ দিতে হবে। এছাড়া পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি), জয়েন্টভেঞ্চার ইত্যাদির মাধ্যমে প্রযুক্তি হস্তান্তরসহ বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে।
ড. শামসুল আলম বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অনেক রয়েছে। ব্যাংকে প্রচুর অলস টাকা রয়েছে। সেক্ষেত্রে সম্পদ প্রাপ্তি সমস্যা না হলেও কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ হচ্ছে না। ফলে পুঁজি পাচার হয়ে যাচ্ছে। প্রতিবছর প্রচুর অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে। এর কারণ খুঁজে বের করতে হবে। তবে আমার মতে অন্যতম কারণ হচ্ছে পুঁজির নিরাপত্তার অভাব। অর্থনৈতিক বহুমুখিতা আনতে বেসরকারি খাতকে গবেষণায় প্রচুর বিনিয়োগ করতে হবে।
কাজুহিকো হিগুচি বলেন, সরকার সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। এডিবি কান্ট্রি পার্টনারশিপ স্ট্রাটেজি সরকারের এ পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। দারিদ্র্য নিরসনে বাংলাদেশ উন্নতি করেছে। এক্ষেত্রে আরও উন্নতির সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশকে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে দক্ষ জনশক্তি ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
বেগম শামসুন নাহার বলেন, প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক শ্রমিক বিদেশে যাচ্ছে। সরকার মানবসম্পদ উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। বাজেটে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে মানব উন্নয়ন খাতে। সৌদি আরবে শ্রমিক পাঠানো শুরু হচ্ছে। সেই সঙ্গে ওমানসহ বিভিন্ন দেশে মহিলা শ্রমিক পাঠানো হবে।
শ্রীনিবাস রেড্ডি বলেন, তৈরি পোশাক শিল্পে ৬০ মিলিয়ন মহিলা শ্রমিক আছে। তাদের সামাজিক নিরাপত্তা কম। এক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তার সুযোগ বাড়াতে হবে। বাংলাদেশ অদক্ষ শ্রমিক রফতানি করে আর দক্ষ শ্রমিক আমদানি করে। কিন্তু প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে এর বিপরীত করতে হবে। তাছাড়া অসামঞ্জস্য পলিসির সংস্কার করতে হবে। যাতে পোশাক শিল্পের বাইরেও অন্য শিল্পগুলো বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়।