হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা আর কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত করে তোলা বাবুই পাখির আবাসস্থল খেজুর গাছ। বিলুপ্ত হওয়ার ফলে আর সেদিন গুলোর মত দেখা যায়না শীত আসলে সূয্যি মামা জাগার সাথে সাথে গ্রামীণ পথ ধরে কাঁধে রসের ভার বহন করা খেজুর রস বিক্রেতা গাছিদের ডাক “ও ভাই, রস লাগবে না, রস?” এবং নতুন রসের ঘ্রাণে চতুর্দিকে মৌ মৌ করা। শীতের সকালে কাঁপা কাঁপা হাতে মুড়ি দিয়ে খেজুর রস পানের দৃশ্য মনে দোলা দিয়ে যায় আজও।
কালের বিবর্তনে এখন গাছগুলোর ডালে বাবুই পাখির বাসার দেখা মেলানো ভার। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের সঙ্গে এ গাছের সম্পর্ক পুরানো ও নিবিড়। দেশে সাধারণতঃ পুরুষ এবং স্ত্রী দু’ প্রজাতির খেজুর গাছ দেখা যায়। স্ত্রী প্রজাতির গাছে খেজুর ও রস উভয়ই পাওয়া যায়। পুরুষ প্রজাতির খেঁজুর গাছ থেকে শুধুই রস সংগ্রহ করা যায়। শীত আসলে মধুর গন্ধের খেজুর রসে তৈরী নানা রকম পিঠা, পায়েস খাওয়ার বড় সাধ জাগলেও এ শুধু স্বপ্নই থেকে যায়। দেখা মিলে না খেজুর রস বিক্রেতাদের।
খেজুর গাছ বিলুপ্ত হওয়ার কারনে খেজুর রস বিক্রেতা (গাছি) এ পেশার সঙ্গে জড়িত ছিল তারা বাধ্য হয়ে অন্য পথ বেছে নিচ্ছে। গ্রাম বাংলার মাঠে আর মেঠোপথের ধারে কোথাও কোথাও দু’একটি খেজুর গাছ দাঁড়িয়ে কালের সাক্ষী হয়ে থাকলেও তা চাহিদার তুলনায় যৎসামান্য। ১৫/২০বছর আগেও দেখা যেত গ্রাম বাংলা আনাছো কানাছে সারি সারি খেজুর গাছ। গাছিরা দিনের মধ্যভাগ থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ধারাল দা, মুগির আর রস সংগ্রহের হাঁড়ি পিঠের পেছনে একটি লম্বা ঝুড়িতে বেঁধে এ বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি বয়ে নিয়ে যেত খেজুর গাছ কাটার জন্য। এ কাজে গাছিদের বাড়ির ছোট ছেলে-মেয়েরা সাহায্য করত পেছনে পেছনে হাঁড়ি বহন করে। আবার খুব ভোর থেকে রস সংগ্রহ করে খেজুর গুড় তৈরির জন্য একত্রিত করত। সকাল থেকে দিনের অর্ধবেলা পর্যন্ত মা-বোনেরা রস থেকে গুড় তৈরি করত। আবার অনেক গাছি কুয়াশার ভেতরেই গ্রামীণ পথ ধরে কাঁধে রসের ভার বহন করে হেঁটে চলত রস বিক্রির আশায়।
দিনের বেলায় পাখিরা রসের চুঙ্গিতে বসে মনের সুখে রস খেয়ে উড়ে যেত। মৌমাছিও রসের আশায় ভোঁ ভোঁ করে উড়ে বেড়াত। কোন কোন সময় রাতে আঁধারে দুরন্ত ছেলে মেয়েরা চিকিন পাইপ দিয়ে অথবা গাছে উঠে অন্য উপায়ে হাড়ির রসগুলো সাবাড় করে পানি ভর্তি করে রেখে দিতো। সে দৃশ্য দেখে সত্যিই চোখ জুড়িয়ে যেত সবার। প্রতি বাড়িতে সকাল বেলা খেজুর রসের পায়েস তৈরি হতো।
এখন অন্য অঞ্চল থেকে মাঝেমধ্যে খেজুর রসের ভার নিয়ে রস বিক্রি করতে এলেও চাহিদা বেশি থাকায় দামও বেশি। ছোট একটি রসের হাঁড়ির দাম ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। এ সম্পর্কে লাকসাম উপজেলার এডভোকে বদিউল আলম সজুন বলেন, এখন শীতের সময় খেজুর রস নেই এ কথাটি বিশ্বাস করতে পারছি না।
মনোহরগঞ্জ উপজেলার জাফর মাষ্টার বলেন, আমাদের গ্রামের রস অন্য জেলা শহরে যেত।কিন্তু এখন আমরাই রস পাচ্ছি না। ছোট বাচ্চারা তো রস চিনেই না। গ্রাম বাংলার এক বৃদ্ধ আবুল বাশার জানায় বাপুরে খেজুর রস কই পাব আর সাধের পিঠা পায়েস কিভাবে খাব? এক শ্রেণীর গাছির অসাবধানতার দরুন গাছের মাথা মরে যাচ্ছে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গাছি না থাকায় খেজুর গাছের রস বের করার সঠিক পদ্ধতি না জানার কারণে অনেক খেজুর গাছ অকালে মরে যাচ্ছে। এছাড়া জ্বালানি হিসেবে বা ঘরের খুঁটি হিসেবে ব্যবহারের কারণে প্রায় খেজুর গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। খেজুর গাছের পোড়ানো ইটের রং গাঢ় হয়। এছাড়াও গাছ অপোকৃত সস্তা দামে পাওয়া যায় বলে ইট ভাটায় এর চাহিদা বেশী। এসব কারণে দিন দিন খেজুর গাছ বিলুপ্ত হওয়ায় খেজুরের রস ও খেজুর গাছের সংখ্যা হৃাস পাচ্ছে। গ্রামবাংলার ঐতিহ্য এই খেজুর গাছ আজ অস্তিত্ব সঙ্কটে। যে হারে খেজুর গাছ নিধন হচ্ছে, সে তুলনায় রোপণ করা হয় না। রসনা তৃপ্তির উপকরণ সুমিষ্ট রসের জন্যই নয়, জীবনের প্রয়োজনে প্রকৃতির ভারসাম্য ও বাংলার ঐতিহ্য রায় ব্যাপকভাবে খেজুর গাছ রোপণ করা দরকার এমন আকুতি অনেকের। একদিন পুরোপুরি খেজুর গাছ হারিয়ে যাবে শুধু বইয়ের পাতায় খেজুর গাছের কথা লেখা ছাড়া আর কিছুই দেখা যাবেনা। আসুন গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যকে দরে রাখার জন্য খেজুর গাছ কাটা বন্ধ করে সকলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে খেজুর রসের তৈরী নানা স্বাদের খাবার নিয়ে মেতে উঠি।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.