চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্র বা প্রেসক্রিপশন লেখা সম্পর্কিত হাইকোর্টের নির্দেশনাকে আমরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও যুগান্তকারী একটি রুল বলব। জনস্বার্থে করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট চিকিৎসার প্রেসক্রিপশন পাঠযোগ্য তথা বড় হরফে বা কম্পিউটার মুদ্রণের মাধ্যমে লিখতে নির্দেশ দিয়েছেন। দেশের সব সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসক যাতে এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেন সেজন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে এক মাসের মধ্যে প্রজ্ঞাপন জারি করতে বলা হয়েছে। এছাড়া প্রেসক্রিপশনে ওষুধের জেনেরিক নাম স্পষ্ট করে লিখতে বিধি তৈরির নির্দেশ কেন দেয়া হবে না, রুলে তাও জানতে চাওয়া হয়েছে।
প্রেসক্রিপশনে চিকিৎসকদের দুর্বোধ্য হাতের লেখার বিষয়টি সর্বজনবিদিত। দুর্বোধ্য হাতের লেখার কারণে রোগীদের প্রায়ই বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হল, চিকিৎসকের লেখা সঠিকভাবে বুঝতে না পারায় ওষুধের দোকান থেকে অনেক সময় ভুল ওষুধ গছিয়ে দেয়া হয়। এতে রোগীরা সুস্থ হওয়ার পরিবর্তে অধিকতর স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েন। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এ দেশের চিকিৎসকরা প্রেসক্রিপশনে ওষুধের জেনেরিক নাম (ওষুধের মূল কেমিক্যাল কম্পোজিশনের নাম) না লিখে ব্র্যান্ডের নাম লিখে থাকেন। এর ফলে তারা প্রেসক্রিপশনে তাদের পছন্দমতো কোম্পানির ওষুধের নাম লেখার সুযোগ পান। এ ক্ষেত্রে অনেক চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নেয়ার জোরালো অভিযোগ রয়েছে। দেশের সিংহভাগ মানুষের এ সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকায় চিকিৎসকরা যে ওষুধের ব্র্যান্ড নাম লিখে দেন, রোগীরা তা-ই কিনতে বাধ্য হন। কোনো চিকিৎসক যদি ওষুধ কোম্পানির অনৈতিক সুবিধা নিয়ে বেশি দামের অথবা নিন্মমানের ওষুধের ব্র্যান্ড নাম লেখেন, সেক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হন সংশ্লিষ্ট রোগীরা। চিকিৎসকদের এ ধরনের অনৈতিক প্র্যাকটিস রোধে প্রেসক্রিপশনে ওষুধের জেনেরিক নাম লেখা বাধ্যতামূলক করে আইন থাকা জরুরি। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতেও এমন নিয়ম রয়েছে। আমরা আশা করছি, প্রেসক্রিপশন লেখা সম্পর্কিত হাইকোর্টের নির্দেশনার পর সরকার অবিলম্বে এ আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেবে।
গত ১৭ ডিসেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকে ‘দুর্বোধ্য ব্যবস্থাপত্র : ভুল ওষুধ গ্রহণের ঝুঁকিতে রোগীরা’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এ প্রতিবেদন যুক্ত করে গত ২ জানুয়ারি হাইকোর্টে একটি রিট করে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ। এরই পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট গত সোমবার উল্লিখিত নির্দেশনা জারি করেছেন। বিষয়টি হাইকোর্টের দৃষ্টিগোচরে আনার জন্য সংগঠনটি সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। এ দেশে চিকিৎসা ক্ষেত্রে সবচেয়ে অবহেলা ও ভোগান্তির শিকার হয় দরিদ্র ও অশিক্ষিত জনগোষ্ঠী। এর একটি বড় কারণ চিকিৎসকদের দুর্বোধ্য প্রেসক্রিপশন এবং তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অনৈতিক কার্যকলাপ। হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়িত হলে এ দুই চর্চাই বন্ধ হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। সরকার এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেবে, এটাই কাম্য। দুঃখজনক হলেও সত্য, অতীতে জনস্বার্থে দেয়া হাইকোর্টের অনেক নির্দেশনা বাস্তবায়নে সরকারকে জোরালো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। এবার যেন তেমনটি না হয়। জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে প্রেসক্রিপশন লেখা সম্পর্কিত হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়নের বিষয়টি সরকারের কাছে যথাযথ গুরুত্ব পাবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.