বিঝু হচ্ছে চাকমাদের সবচেয়ে বড় সামাজিক উৎসব। রাঙামাটি, খাগড়াছডড়ি ও বান্দরবান এই তিন জেলা নিয়ে গড়ে ওঠা পার্বত্য চট্টগ্রাম বিঝুকে ঘিরে যেন নতুন করে সাজে প্রতিবছর অন্য রকম এক আনন্দে।
বাংলা মাসের চৈত্র সংক্রান্তি শেষ দুদিন ও পহেলা বৈশাখ এই তিনদিন ধরে চলে বিঝু উৎসব। বিঝুকে ঘিরে পুরনো বছরকে বিদায় আর নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে সবুজ পাহাড়ে চলে নানা আয়োজন। চাকমারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বি হলেও এখনো তারা উৎসব, বিয়ে, নতুন বাড়ি করা বা জুমের (পাহাড়ের ঢালে বিশেষ ধরনের চাষাবাদ) ফসল তোলার ক্ষেত্রে আদিধর্ম ‘প্রতি পূজার’ বেশ কিছু বিষয়-আশয় বংশপরম্পরায় পালন করেন।
তাই ফুল বিঝু, মূল বিঝু ও গইজ্জা-পইজ্জা বিঝু এই তিনদিনের বিঝু উৎসবে আদিধর্মের বেশ কিছু রীতি এখনো পালন করা হয়।
ফুলবিঝু হচ্ছে, বিঝুর প্রথম দিন। এ দিন পাহাড়িদের বাড়ী-ঘর ধুয়ে-মুছে ফুল ও লতাপাতা দিয়ে সাজানো হয়। শিশু-কিশোররা খুব ভোরে পাহাড়ি ছোট নদী বা ছড়ায় গিযয়ে স্নান সেরে নেয়। তারপর সূর্যোদয়ের লগ্নে পানির দেবতার উদ্দেশ্যে কলাপাতায় আতপচাল, ফল-মুল, চিনি বা গুড়, ফুল, প্রজ্জ্বলিত মোম বা প্রদীপ–ইত্যাদি নৈবেদ্য সাজিযয়ে পুজা দেয়াা হয়। এর পর বৌদ্ধ মন্দিরে গিয়ে পূজা-অর্চণা চলে। ছোট্ট ছেলে- মেয়েরা এ বাড়ি-সে বাড়ি ঘুরে বড়দের আশির্বাদ নেয়। বৌদ্ধ পুরোহিত বা ভান্তেরা এ দিন পাবেন নতুন গেরুয়া কাপড়। গৃহ-পালিত পশু-পাখিকে এ দিন সকালে স্নান করানো হয়।
পরদিন মূল বিঝুতে বাড়ির সকলে নতুন জামা-কাপড় পরেন। দল বেঁধে চলে এ পাড়া সে পাড়া ঘুরে নানান ধরণের পাহাড়ি খাবার, পিঠে আর মদ খাওয়া। বিঝু উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ ‘পাজন’ নামে একধরণের তরকারি। ৩৬ রকমের পদ দিয়ে বানানো হয় এই খাবার। পাজনে নূন্যতম ২০ রকমের পদ থাকতে হয়। বুনো আলু, হাঙরের শুটকি, চিংড়ি মাছ, কাঁচা কাঁঠাল, মটর ছোলা, সিমের বিচি, কচি বেত, ও বাঁশের ডগাসহ অন্যান্য গ্রীস্মকালীন তরি-তরকারি এবং ‘সিদোল’ নামে এক ধরণের শুটকি মাছের পেস্ট মিলিয়ে রান্না করা হয় সুস্বাদু পাজন। যে বাড়িতে সবচেয়ে বেশি পদের খাবার দিয়ে পাজন বানানো হয়, সে বাড়ির সুনাম বাড়ে বিঝুর সময়। বিঝুকে কেন্দ্রে করে ভাত থেকে এ সময় বানানো হয় দু’ধরণের উৎকৃষ্ট মানের মদ। একটি হচ্ছে দো-চোয়ানি, আরেকটি হচ্ছে ভাত পঁচিয়ে বানানো ভাতের রসজগরা বা কাঞ্জি। দো-চোয়ানির রঙ একেবারে পানির মতো স্বচ্ছ। এটি ভাত পঁচিয়ে তার রস ডিস্টিল করে বানানো হয়। দুবার ডিস্টিল বা চোয়ানো হয় বলে এর এমন নামকরণ। খুবই কড়া ধরণের মদ। বিন্নি চালের ভাত থেকে তৈরি ভাল মানের দোচায়ানিতে ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ অ্যালকোহল থাকে।
তবে জগরা অতোটা কড়া নয়। এটি দেখতে ফ্যাকাশে সাদা রঙের, খেতে একটু টক টক, মিষ্টি মিষ্টি। এতে অ্যালকোহলের পরিমান থাকে খুবই কম। আমার চাকমা বন্ধুরা জগরাকে দুষ্টুমি করে বলেন ‘চাকমা বিয়ার’!
বিঝুর দিনগুলোতে ছেলেমেয়ে, বুড়ো-বুড়ির মদ খেতে কোনো বাধা নেই। তবে মদ খেয়ে মাতলামি করা চাকমা সমাজে গর্হিত অপরাধ। মদ খাবার জন্য সিনিয়র-জুনিয়ররা আলাদা আলাদা আসর বসায়। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে পানাহার। বাংলা নববর্ষের দিন হচ্ছে বিঝুর শেষ দিন, গইজ্জা-পইজ্জা বিঝু। চাকমা ভাষায়, গইজ্জা-পইজ্জা কথার অর্থ হচ্ছে গড়াগড়ি। এর আগের দুদিন উৎসবের ধকল সেরে সবাই নিজ নিজ বাড়িতে আয়েশ করা গডাগড়ি দিয়ে বিশ্রাম নেবেন, তাই বুঝি এমন নামকরণ। পাঁচ-ছয় দশক আগেও ছেলে-মেয়েদের খেলার জন্য বিঝুর দিনগুলোতে গ্রামের বড় বড় গাছে দোলনা বাঁধা হতো। ‘গিলা’ খেলা, লাটিম খেলা, তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠার প্রতিযোগিতা, ঘুড়ি ও ফানুস ওড়ানো, গেংগুলি গীত, যাত্রার পালা এসব ছিল প্রায় ধূসর হওয়া বিঝুর অন্যতম আকর্ষন।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.