উন্নয়ন প্রকল্পে অনিয়ম
উন্নয়ন প্রকল্পে কেনাকাটায় অনিয়ম, জালিয়াতি ও প্রতারণা বাড়ছে। এ ধরনের অপরাধে জড়িত ২৬০টি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে কাগুজে দরপত্রের অনিয়মে জড়িত ১৯০টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এবং ই-টেন্ডারিং কার্যক্রমে জড়িত ৭০টি প্রতিষ্ঠান বা ফার্মকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি এই শাস্তির আওতায় তালিকাভুক্তরা কোনো দরপত্রে অংশ নিতে পারে না। সরকারি যে কোনো প্রতিষ্ঠানের কাজ পাওয়ার যোগ্যতা হারায়। মূলত সনদ জালিয়াতি, ভুয়া অভিজ্ঞতার সনদ দাখিল, দরপত্রের শর্ত ভঙ্গ ও প্রতারণার অপরাধে প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ শাস্তি দেয়া হয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট (সিপিটিইউ) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
প্রকল্পে দুর্নীতি প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল যুগান্তরকে বলেন, প্রকল্পে আর্থিক দুর্নীতি হলেও সেটি ধরা সহজ নয়। আইএমইডি এক টাকার দুর্নীতি খুঁজে পায় না বা পাবেও না। কারণ প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা ভাউচার দিয়ে হিসাব মিলিয়ে রাখে। ওরা কি ভাউচার দিয়ে মিলিয়ে রাখে না? বাজেটে ছিল এত টাকা, একনেক থেকে প্রকল্প যায় তারপর তারা প্রকল্প বাস্তবায়নের নিয়মের মধ্য থেকেই নানা ধরনের অনিয়ম করে। ফলে তাদের সহজে ধরা যায় না। তবে ধারণা করা যায় দুর্নীতি হয়। এক্ষেত্রে যেটি করতে হবে তা হচ্ছে সংস্কার। সংস্কারের মাধ্যমেই দুর্নীতি দূর করতে হবে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ই-টেন্ডারিং কার্যক্রমে এখন পর্যন্ত মোট প্রায় ৭০টি প্রতিষ্ঠান বা ফার্মকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে চলতি বছরে ৩৭টি প্রতিষ্ঠান, ২০১৫ সালে ২৫টি এবং ২০১৪ সালে ৮টি প্রতিষ্ঠানকে তালিকাভুক্ত করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি তালিকাভুক্ত হয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) থেকে। এরপরই বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অবস্থান।
কালো তালিকা প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে আগে এভাবে ব্যাপকভিত্তিক কালো তালিকা করা হতো না। এখন সেটি করা ইতিবাচক। কারণ যারা তালিকায় থাকে তাদের বদনাম হয় এবং ওই সময়ের মধ্যে অন্য সংস্থার কাজও পায় না। তবে তারা যাতে অন্য নামে কাজ না পায় সেদিকে নজর রাখতে হবে। ই-টেন্ডারিংয়েও দুর্নীতির চেষ্টা হচ্ছে। এক্ষেত্রে যারা দুর্নীতি করে তারা যারা দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে আছেন তাদের তুলনায় অনেক বেশি দক্ষ হয়। এজন্য একটি সিস্টেম দিয়ে দুর্নীতি বন্ধ করা যাবে না। যেটি করতে হবে তা হল দুর্নীতি যারা করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে ধীরে ধীরে দুর্নীতি কমে আসবে।
সূত্রমতে, কালো তালিকায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, এলজিইডির একটি দরপত্রে ৩টি জাল সনদ জমা দেয়ায় ঢাকার দি রেডিয়েন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনসালটিং ফার্মকে চলতি বছরের জুন মাস থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসের জন্য কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। একই অভিযোগে পটুয়াখালীর এম/এস আবুল কালাম আজাদকে ছয় মাসের কালো তালিকায় রাখা হয়েছে। সিলেটের এম/এস কুশিয়ারা ট্রেডিং রয়েছে চলতি বছরের মে মাস থেকে ২০১৮ সালের ৪ মে পর্যন্ত মেয়াদে কালো তালিকায়। প্রতারণার জন্য ভোলার এম/এস জুলফিকার আহমেদ রয়েছে চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে ২০১৮ সালের ১ মার্চ পর্যন্ত কালো তালিকায়।
এছাড়া বিভিন্ন মেয়াদে কালো তালিকায় রয়েছে চট্টগ্রামের এম/এস মাহাদি অ্যান্ড কোম্পানি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এবি ইঞ্জিনিয়ার্স, টাঙ্গাইলের মো. আমজাদ হোসাইন, মনির এন্টারপ্রাইজ, নিলয় এন্টারপ্রাইজ, ঢাকার এইচএম হেলাল এন্টারপ্রাইজ, আসিফ ট্রেডার্স, চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানি, কক্সবাজারের মহেশখালী এন্টারপ্রাইজ, ঢাকার মেসার্স তানভীর এন্টারপ্রাইজ, নিউ টেক্স প্যাসিফিক লিমিটেড, সুনামগঞ্জের রায় এন্টারপ্রাইজ, টাঙ্গাইলের মেসার্স সুনভী ট্রেডার্স এবং যশোরের হেরা এন্টারপ্রাইজ ইত্যাদি।
এ প্রসঙ্গে সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) মহাপরিচালক ফারুক হোসেন যুগান্তরকে বলেন, অনেক ঠিকাদার নিজেই জাল অভিজ্ঞতার সনদ বানিয়ে স্ক্যান করে পাঠায়। আমরা যখন খোঁজ নিতে যাই, তখন তা জাল প্রমাণিত হয়। এটি গুরুতর প্রতারণা। তাছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠান কন্ট্রাক্ট সই হওয়ার পর সে অনুযায়ী বাস্তবায়ন করে না। চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে। তখন সেসব প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়।
অন্যদিকে কাগুজে দরপত্রের ক্ষেত্রে গত কয়েক বছরে প্রায় ১৯০টি প্রতিষ্ঠান বা ফার্মকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানকে অনির্দিষ্টকালের জন্য এই তালিকায় রাখা হয়েছে।
যেসব প্রতিষ্ঠান কালো তালিকাভুক্ত করেছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে খাদ্য অধিদফতর, গণপূর্ত অধিদফতর, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, স্পেশাল ব্রাঞ্চ, সড়ক ও জনপথ অধিদফতর, এলজিইডি, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনস অথরিটি, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ টেলিভিশন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, স্থানীয় সরকার বিভাগ, ভূমি মন্ত্রণালয় এবং ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন।
কালো তালিকায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম ঢাকার মেসার্স ইমসন্স ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, মামুন এন্টারপ্রাইজ, মিডিয়াওয়ান অ্যাডভারটাইজিং অ্যান্ড প্রিন্টিং, মেসার্স তাহামিনা বেগম, এএম ইন্টারন্যাশনাল পেস্ট কন্ট্রোল, এসএআর কনস্ট্রাকশন, এগ্রোফুডস কমোডিটিস, হাসান এন্টারপ্রাইজ, জাফর বিল্ডার্স লিমিটেড, জসিম এন্টারপ্রাইজ, এশিয়ান টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড, বেঙ্গল টেকনোলজিক্যাল কর্পোরেশন লিমিটেড, বৃষ্টি ইন্টারন্যাশনাল, সিপিএম সিস্টেম লিমিটেড, দিগন্ত অ্যাডভারটাইজিং, জিপি ট্রেডার্স, ময়মনসিংহের হেলথ কেয়ার টেকনোলজি লিমিটেড, বরিশালের পলি ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন, বাগেরহাটের মেসার্স শাজালাল এন্টারপ্রাইজ, পটুয়াখালীর মেসার্স তমা কন্সট্রাকশন অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড এবং সিলেটের এমআর এন্টারপ্রাইজ।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.