চট্টগ্রাম : ‘বর্ষ হয়ে আসে শেষ, দিন হয়ে এলো সমাপন, চৈত্র অবসান/গাহিতে চাহিছে হিয়া পুরাতন ক্লান্ত বরষের / সর্বশেষ গান’ … বাঙলা বর্ষ নিয়ে এভাবেই লিখেছেন কবিগুরু।
ফুল ফুটিয়ে, রিক্ত শাখা নতুন পাতায় ভরিয়ে তুলে, প্রকৃতিতে অফুরন্ত প্রাণপ্রাচুর্য বিলিয়ে চলে গেল বসন্ত। চারদিকে কালবৈশাখী জানিয়ে দিচ্ছে বৈশাখের আগমনের কথা!
শুক্রবার চৈত্রের শেষ দিন, চৈত্রসংক্রান্তি। আবহমান বাংলার ঘরে ঘরে প্রাচীনকাল থেকে মমতা-ভালোবাসা আর উচ্ছ¡লতায় পালিত হয়ে আসছে এ প্রাণের উৎসব।
তাই বাঙালি জাতি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যের বন্ধনে পুরোনো বছরের দিনযাপনের শত জরা-জীর্ণ ধুয়ে-মুছে, আনন্দময় নতুন দিনের প্রত্যাশায় উদযাপন করছে এসব লোকাচার।
সারা দেশের শহর থেকে গ্রাম, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে সবাই মেতে উঠেছে নতুন দিনকে বরণের আশায়।
‘বাংলার ঘরে ঘরে চৈত্র সংক্রান্তিতে বাড়ির আশপাশসহ ব্যবহৃত জিনিসপত্র পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়। তবে এটি দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে। এখন আর আগের মতোচৈত্র সংক্রান্তির উৎসব দেখা যায় না।’ বলছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ইফতেখার ফয়সাল।
তিনি বলেন, এই কর্পোরেট যুগে নগরায়ণের ব্যাপক বিস্তৃতি, জীবনযাত্রার পরিবর্তন ও নিত্যনতুন অনুষঙ্গ যোগ, মানুষের রুচি ও বিশ্বাসের পালাবদলে ঐতিহ্যের অনেক রীতি-রেওয়াজই ঢাকা পড়ে গেছে।’
তবে বাংলা বর্ষবরণের উৎসব নতুন আঙ্গিকে, নতুন রূপে বাঙালি গ্রহণ করছে। তেমনি বাদ যায়নি চৈত্রসংক্রান্তি উৎসবও। উৎসবে নতুনত্ব এলেও গ্রামাঞ্চলে এখনো এসব সংস্কৃতি রয়ে গেছে। নতুনের আহবানে এ দিন শুধু ঘরবাড়িই নয়, দোকানপাটও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করেন দোকানিরা হালখাতাকে সামনে রেখে।
চট্টগ্রাম নগরীর চাকতাই খাতুনগঞ্জেও চলছে হালখাতা অনুষ্ঠানের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। চৈত্র সংক্রান্তির উৎসবের কিছু অনুষঙ্গ নিয়ে বন্দরনগরীতে বিদায় জানানো হচ্ছে পুরোনো বর্ষকে।
বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম যেন একটা উৎসবের নগরীতে পরিণত হয়েছে। পয়লা বৈশাখকে স্বাগত ও পুরোনো বছরকে বিদায় জানাতে চট্টগ্রাম বাওয়া স্কুলে নেওয়া হয়েছে বর্ণাঢ্য কর্মসূচি। সিআরবি শিরিষতলা, ডিসি হিলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন বাঙালির প্রাণের এ উৎসব পালন করছে। সুদূর পঞ্চগড় থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) পড়তে আসা সুকুমার রায় বাংলানিউজকে জানালেন, ‘ওই খানে পুরোনো বছরকে বিভিন্ন লোকজ মেলা ও অনুষ্ঠানে চৈত্রসংক্রান্তি উদযাপন করা হয়। আর নতুন বছরে প্রাকৃতিকসহ নানা দুর্যোগ থেকে রক্ষা ও ভালো ফসলের জন্য ফসলি জমিতে আচার-অর্চনা করে থাকেন গ্রামবাসী।’ চবির ছাত্র লালমনিরহাটের হাসান বলেন, ‘তিস্তা তীরের মানুষেরা বছরের শেষ দিনে তিতা স্বাদের খাবার খান। এইদিন তিতা খেলে মৌসুমি রোগ-ব্যাধি প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়ে বলে আমাদের মুরুব্বিরা বলে থাকেন।’
‘লোকনাথ পঞ্জিকা অনুসারে অনেক প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী মেলা ও চড়কের আয়োজন হয় রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন অঞ্চলে। এসব মেলা সংক্রান্তির দিনে শুরু হয়ে চলে নববর্ষের দিন পর্যন্ত।’ এছাড়াও বরেন্দ্র অঞ্চলের আদিবাসীরাও এসব লোকজ উৎসব পালন করেন বলে বাংলানিউজকে জানান চবিতে পড়–য়া রাজশাহীর আদিবাসী ছাত্র সৌমেন।
এদিকে নববর্ষ ও বর্ষবিদায়কে ঘিরে পাবর্ত্য চট্টগ্রামেও চলছে নিজ নিজ লোকজ উৎসব। রাখাইন তরুণ-তরুণীরা ১৩৭৪ রাখাইন অব্দকে স্বাগত জানিয়ে চট্টগ্রামের কাতালগঞ্জের নবপণ্ডিত বৌদ্ধ বিহারে বৃহস্পতিবার মেতে ওঠেন জলকেলি উৎসবে।
কক্সবাজারেও রাখাইন পল্লীতে ‘সাংগ্রাং পোয়ে বা জলকেলি উৎসব’র আয়োজন করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.