তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি শুরু হবে ২০১৮ সালে। কমপক্ষে আড়াই বছর পর জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে উচ্চমূল্যের এই গ্যাস। কিন্তু সরকার এখনই এর সঙ্গে দাম সমন্বয়ের জন্য স্থানীয় গ্যাসের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করছে। সাত মাসের মাথায় ফের বিতরণ কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে আবাসিকে ছয়শ’ টাকার গ্যাসের দাম ১২’শ টাকা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। একইভাবে বাণিজ্যিক ও শিল্পে ব্যবহারের ক্ষেত্রেও দাম প্রায় দ্বিগুণ করার কথা বলা হয়েছে। মূল্যবৃদ্ধির এ প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে সব পর্যায়ের ভোক্তারা আর্থিক চাপে পড়বেন। সরকারের ভাবমূর্তির ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়ার আশংকা আছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন মূল্যবৃদ্ধির এই উদ্যোগ দেশবিরোধী, শিল্পের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র।
এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি তপন চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, যে গ্যাস ২০১৮ সালে আসবে তার দাম মানুষ কেন আড়াই বছর আগে থেকে দেয়া শুরু করবে। এটা কোনোভাবে হতে পারে না। তিনি বলেন, দেশে যখন বিদ্যুতের ভয়াবহ ক্রাইসিস ছিল তখন সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র ভাড়া এনেছে। এখনও ভর্তুকি দিয়ে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল রেখেছে। একইভাবে এলএনজিতেও ৫-৬ বছর ভর্তুকি দিয়ে সরকারের চালানো উচিত।
এলএনজি আমদানির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের এক্সিলারেট এনার্জির সঙ্গে চুক্তি করেছে সরকার। ২০১৮ সালের শেষদিকে মহেশখালীর ভাসমান টার্মিনাল থেকে দৈনিক ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি পাওয়ার কথা। এখান থেকে ন্যাশনাল গ্রিডের মাধ্যমে ওই গ্যাস যুক্ত হবে প্রাকৃতিক গ্যাসের সঙ্গে। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ এগোলে সবকিছু শেষ হতে সময় লাগবে প্রায় আড়াই বছর। পেট্রোবাংলার হিসাবে বাংলাদেশে বর্তমানে দৈনিক প্রায় ২৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদিত হচ্ছে। গড়ে এই গ্যাসের বিক্রয় মূল্য পড়ছে প্রতি মিলিয়ন ঘনফুট ২.৪ মার্কিন ডলার। বর্তমান বাজারমূল্যে আমদানিকৃত এলএনজির ক্রয়মূল্য পড়বে গড়ে ৮ মার্কিন ডলার। এর সঙ্গে ভ্যাটসহ নানা ধরনের করযুক্ত হওয়ায় দাম দাঁড়াবে ২৩.১১ মার্কিন ডলার। সরকার আমদানি করা এই এলএনজির দাম সমন্বয় করতে চাচ্ছে। এজন্য বিতরণ কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে সব ধরনের গ্যাসের দাম গড়ে প্রায় দ্বিগুণ করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। গ্রাহক (আবাসিক ও শিল্প) পর্যায়ে গড়ে ৮৭.৬৬ শতাংশ এবং বাণিজ্যিক (ক্যাপটিভ) পর্যায়ে ১৩০ শতাংশও বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। ইতিমধ্যে এ নিয়ে গণশুনানি করেছে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। আইন অনুযায়ী, শুনানির পরবর্তী ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে বিইআরসি দাম পুনর্নির্ধারণের বিষয়ে আদেশ দেবে। এ প্রসঙ্গে শুনানিকালে বিইআরসির চেয়ারম্যান এ আর খান বলেছেন, ‘গ্রাহকদের স্বার্থ সংরক্ষণ করেই গ্যাসের দাম পুনর্নির্ধারণের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’
কিন্তু জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এলএনজির এখনও কোনো খবর নেই এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে গ্যাসের দাম বাড়ানোর তোড়জোড়। এটা কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়। তাছাড়া বিতরণ কোম্পানিগুলো গণশুনানিতে তাদের দাম বাড়ানোর পক্ষে কোনো যুক্তি দেখাতে পারেনি। তিতাস গ্যাস আবাসিক গ্রাহকদের কাছ থেকে এখনোই অতিরিক্ত দাম নিচ্ছে। অথচ দুই বার্নার চুলার জন্য ৬৫০ টাকার পরিবর্তে এক হাজার ২০০ টাকা দাম নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়। এটা গ্রাহকদের সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণা।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গ্যাসের দাম বাড়ানো নিয়ে সরকারের মধ্যে বিভক্তি রয়েছে। একটি অংশ এই মুহূর্তে গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিপক্ষে। অপর অংশ চাচ্ছে বাসাবাড়ি, সিএনজি ও ক্যাপটিভ পাওয়ার খাতে হলেও ধাপে ধাপে দাম বাড়ানো হোক। কিন্তু সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী, ভোক্তা, গণপরিবহন মালিকরাও দাম বাড়ানোর বিপক্ষে। খোদ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনই (বিইআরসি) চাচ্ছে না গ্যাসের দাম বাড়ুক। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডও (পিডিবি) মনে করছেন গ্যাসের দাম বাড়লে বিদ্যুতেরও দাম বাড়াবে। ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা ইতিমধ্যে বিভিন্ন সভা-সেমিনার করে গ্যাসের দাম না বাড়ানোর পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
এদিকে ১৯ সেপ্টেম্বর গণশুনানির শেষ দিন কোম্পানিগুলোর রাজস্ব চাহিদা নিরূপণ করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি জানিয়েছে বিতরণ চার্জ বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। যুক্তি দেখিয়ে তারা বলেছে, গ্যাস খাত থেকে ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) ও সম্পূরক শুল্কসহ রাজস্ব পরিশোধে প্রায় ৮১ শতাংশ অর্থ সরকারি কোষাগারে চলে যায়। এ শুল্ক ও কর গ্রহণের হার ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ কমিয়ে দিলে এখনই গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের দাম বাড়ানোর দরকার হবে না।
সর্বশেষ দাম বাড়ানোর ৭ মাসের মাথায় ফের গ্যাসের দাম ৬২ শতাংশ থেকে ১৪০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়ে বিইআরসির কাছে প্রস্তাব দেয় ছয়টি বিতরণকারী কোম্পানি, সঞ্চালন কোম্পানি জিটিসিএল এবং উৎপাদনকারী সংস্থা পেট্রোবাংলা ও বাপেক্স। প্রস্তাবে বর্তমানে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য প্রতি ঘন মিটার গ্যাসের দাম ২ টাকা ৮২ পয়সার পরিবর্তে ৬৩ শতাংশ বাড়িয়ে ৪ টাকা ৬০ পয়সা নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে। আবাসিকে এক চুলার জন্য বর্তমান ৬০০ টাকার পরিবর্তে ১ হাজার ১০০ টাকা এবং দুই চুলার জন্য ৬৫০ টাকার পরিবর্তে ১ হাজার ২০০ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়।
সার কারখানায় ২ টাকা ৫৮ পয়সা থেকে ৭১ শতাংশ বাড়িয়ে ৪ টাকা ৪১ পয়সা, ক্যাপটিভ পাওয়ারে ৮ টাকা ৩৬ পয়সা থেকে ১৩০ শতাংশ বাড়িয়ে ১৯ টাকা ২৬ পয়সা ও শিল্পে ৬ টাকা ৭৪ পয়সা থেকে ৬২ শতাংশ বাড়িয়ে ১০ টাকা ৯৫ পয়সা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। সিএনজি স্টেশনে সরবরাহ করা গ্যাসের দাম ৮৩ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে কোম্পানিগুলো। এতে গ্রাহক পর্যায়ে ২৭ টাকার পরিবর্তে প্রতি ঘন মিটারের দাম পড়বে ৪৯ টাকা ৫০ পয়সা।
রোববার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিষয়ে উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক ই এলাহী চৌধুরীর সভাপতিত্বে বৈঠকে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সদস্য ও পিডিবি কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন সেখানে জানিয়েছে তারা গ্যাসের দাম বাড়ানোর পক্ষে নয়। বলেছে, ৭ থেকে ১৮ আগস্ট পর্যন্ত তারা গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিষয়ে বিতরণ কোম্পানিগুলোর দর প্রস্তাব নিয়ে গণশুনানি করেছে। সেখানে ভোক্তাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের যে অগ্নিমূর্তি দেখেছেন তাতে তারা উদ্বিগ্ন। সেখানে ব্যবসায়ী নেতা ও শিল্প মালিকদের যে ক্ষোভ দেখেছেন তাতে তারা শংকিত। শুনানিতে বিতরণ কোম্পানিগুলো গ্যাসের দাম বাড়ানোর পক্ষে কোনো যুক্তি উপস্থাপন করতে পারেনি। ভোক্তা প্রতিনিধি, জনগণ ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের জেরার জবাবে কোনো কোম্পানিই সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেনি। বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির রিপোর্টও গ্যাসের দাম বাড়ানোর পক্ষে ছিল না। পিডিবি কর্মকর্তারাও বৈঠকে বলেছেন, এ মুহূর্তে গ্যাসের দাম বাড়লে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। তাতে বাধ্য হয়ে বিদ্যুতের দামও বাড়াতে হবে। বিদ্যুৎ বিভাগেরও কেউ কেউ এ মুহূর্তে গ্যাসের দাম বাড়ানোর পক্ষে নয় বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে।
তবে অপর অংশ চাচ্ছে এক সঙ্গে দাম না বাড়িয়েছে ২০২৩-২৪ সাল পর্যন্ত ধাপে ধাপে গ্যাসের দাম বাড়ানো হোক। এতে গ্রাহক পর্যায়ে বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া হবে না। তাদের বক্তব্য ছিল আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দাম সমন্বয় করতে গ্যাসের দাম বাড়ানো দরকার।
শিল্পোদ্যোক্তা ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, গ্যাসভিত্তিক শিল্পে গ্যাসের দর বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা থাকা উচিত। এটি নিশ্চিত করা গেলে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা নেয়া সহজ হয়। তাদের বক্তব্য গ্যাসভিত্তিক কিছু শিল্পের জন্য প্রস্তাবিত মূল্য কার্যকর হলে তা হবে অস্বাভাবিক। এক বছরের মাথায় ক্ষেত্রবিশেষে তা ৪৬১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে বস্ত্র খাতের অনেক শিল্পই টিকে থাকতে পারবে না। এর বিরূপ প্রভাব পড়বে গার্মেন্ট শিল্পের ওপরও।
ব্যবসায়ীরা বলেছেন, শিল্পে ব্যবহার করা গ্যাসের (ক্যাপটিভ) অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধির প্রস্তাবের পর অনেকগুলো শিল্প প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বড় অংকের বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত স্থগিত রেখেছেন। তাদের মতে অনেক উদ্যোক্তারা অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন। বস্ত্র খাতের উদ্যোক্তাদের গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ অর্থাৎ ক্যাপটিভ পাওয়ারের ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু প্রস্তাবিত দর বৃদ্ধি কার্যকর হলে অনেকের জন্য সুতা কিংবা বস্ত্র উৎপাদন লাভজনক হবে না বরং লোকসান গুনতে হবে।
ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, গ্যাসচালিত ক্যাপটিভ জেনারেটর দিয়ে স্পিনিং মিলে উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুতের দাম পড়ে ৪ টাকা ২০ পয়সা। মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব কার্যকর হলে দাম পড়বে সাড়ে ৯ টাকার বেশি। এতে প্রতি কেজি সুতার দাম ৪০ থেকে ৫০ সেন্ট বেড়ে যাবে।
টেক্সটাইল মিল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি আবদুল মতিন বলেন, সরকার শিল্প কারখানায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ দিতে না পারায় বাধ্য হয়ে শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকরা ক্যাপটিভ পাওয়ারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে শিল্প প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছিলেন। কিন্তু ৭ মাসের মাথায় দ্বিতীয় দফায় ক্যাপটিভে গ্যাসের দাম ১৩০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব শিল্প প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রের শামিল। তিনি বলেন, সরকার ব্যয়বহুল বিদ্যুৎ কেন্দ্র রেন্টাল, কুইক রেন্টাল চালাচ্ছে গ্যাস দিয়ে। অলাভজনক সার কারখানা চালাচ্ছে গ্যাস দিয়ে। কিন্তু যে শিল্প কারখানা দেশের প্রাণ সে শিল্পে ক্যাপটিভের অনুমোদন দিচ্ছে না। যারা এখনও ক্যাপটিভ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছেন তারা যাতে সেটা করতে না পারেন সেজন্য এ খাতে গ্যাসের দাম এক লাফে ১৩০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এটা শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।
বিইআরসির পরিচালক (গ্যাস) একেএম মনোয়ার হোসেন বলেন, ‘পেট্রোবাংলা, বাপেক্স ও বিতরণ-সঞ্চালন কোম্পানিগুলোর প্রস্তাব, শুনানির যুক্তি-তর্ক বিশ্লেষণ এবং অন্যান্য মূল্যায়নের কাজ চলছে। গ্যাসের দাম পুনর্নির্ধারণ করা হবে কিনা বা কতটুকু হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.