বৈধ পথে রেমিটেন্স কম আসায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ছে। সরকার হারাচ্ছে বিপুল অংকের বৈদেশিক মুদ্রা। এ অবস্থায় প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংককে বাণিজ্যিক ব্যাংকে রূপান্তর করা হচ্ছে। পাশাপাশি বিদ্যমান আইনের আওতায় এ ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিটেন্স আনার কার্যক্রম গ্রহণ এবং ব্যাংকটির আইন সংশোধনে গঠিত সরকারি কমিটির রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত অর্থ মন্ত্রণালয়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে এ সংক্রান্ত বৈঠক থেকে সিদ্ধান্তগুলো নেয়া হয়। সেখানে রেমিটেন্স হ্রাসের প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করে দ্রুত একটি প্রতিবেদন দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংককে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সর্বশেষ বিশ্বব্যাংকের ইকোনমিক আপডেট রিপোর্টে রেমিটেন্স কমে যাওয়ার বিষয়টি উঠে আসে- যা অবহিত করা হয় প্রধানমন্ত্রীকে। তিনি রেমিটেন্স কমার কারণ শনাক্ত করা এবং প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর উদ্যোগ নেয়ার নির্দেশ দেন। জানতে চাইলে অর্থ সচিব (সিনিয়র) মাহবুব আহমেদ বলেন, বিদেশে জনসংখ্যা রফতানি বাড়া সত্ত্বেও রেমিটেন্স প্রবাহ কমছে। কেন কমছে, এর কারণ বের করতে বিভিন্ন পর্যায়ে মনিটরিং করা হচ্ছে। তাদের রিপোর্ট পাওয়ার পর কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া হবে।
জানা গেছে, গত বছরের ডিসেম্বর মাসে দেশে রেমিটেন্স আসে প্রায় ৯৬ কোটি ডলার। আগের বছরের একই মাসে যা ছিল ১৩১ কোটি ডলার। এ হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে শুধু এক মাসেই রেমিটেন্স ঘাটতি দাঁড়ায় ৩৫ কোটি ডলার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, ২০১৬ সালে রেমিটেন্স আসার পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৩৬ কোটি ডলার। আগের বছরে যা ছিল ১ হাজার ৫৩২ কোটি ডলার। এই হিসাবে রেমিটেন্স কমেছে ১৭১ কোটি ডলার। শতকরা হিসাবে যা প্রায় ১১ শতাংশ। এছাড়া চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬ মাসে রেমিটেন্স এসেছে ৬১৭ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল ৭৪৯ কোটি ডলার। ওই হিসাবে রেমিটেন্স কমেছে ১৩২ কোটি ডলার। শতকরা হিসাবে যা প্রায় ১৮ শতাংশ।
এই রেমিটেন্স হ্রাস পাওয়ার কারণ অনুসন্ধান করতে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক শীর্ষ রেমিটেন্স আহরণকারী ৩০টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সিইওদের নিয়ে বৈঠক করেছেন। ওই বৈঠকেও রেমিটেন্স কমার পেছনে ৬টি কারণ শনাক্ত করা হয়।
কারণগুলো হচ্ছে- বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দামের ধারাবাহিক পতন ও মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধাবস্থার কারণে অর্থনৈতিক স্থবিরতা, পাউন্ড, ইউরো, রিংগিত ও সিঙ্গাপুর ডলারসহ অন্যান্য দেশের মুদ্রার মান হ্রাস, প্রতিযোগিতামূলক ডলারের বিনিময় হার হ্রাস, বিকাশের মাধ্যমে রেমিটেন্স আসা, প্রবাসী আয়ের উৎস দেশগুলোতে আইন-কানুন কঠোর হওয়া এবং যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে মানি ট্রান্সফার কোম্পানির ব্যাংক হিসাব বন্ধ করে দেয়ার প্রভাব পড়েছে রেমিটেন্স প্রবাহের ওপর।
এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, অর্থনীতির কিছু সূচক ইতিবাচক ও কিছু নেতিবাচক রয়েছে। এরমধ্যে রেমিটেন্স ধারাবাহিক কমছে। ব্যাংকের মুদ্রার বিনিময় হার ও খোলা বাজারের হারের ব্যবধান অনেক বেড়েছে। রেমিটেন্স কমার এটি একটি বড় কারণ। অফিসিয়াল মুদ্রার বিনিময় হার অবমূল্যায়ন করে টাকার মূল্য বাড়ানোর সুপারিশ করেন এই অর্থনীতিবিদ।
এদিকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এ নিয়ে বৈঠকে বৈধভাবে রেমিটেন্স আনতে প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন ২৫০ কোটি টাকা দেয়ার একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বর্তমানে এই ব্যাংকের মূলধন হচ্ছে ১শ’ কোটি টাকা। আইন অনুযায়ী যে কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিশোধ মূলধনের পরিমাণ থেকে হবে ৪০০ কোটি টাকা। সম্প্রতি রেমিটেন্স হ্রাস পাওয়ার পেছনে একটি কারণ হচ্ছে বৈধভাবে রেমিটেন্স কমেছে। সেটি মোকাবেলায় ব্যাংকটিকে বাণিজ্যিক ব্যাংকে রূপান্তরের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এর কার্যক্রম শুরু করা হবে। ওই বৈঠকে বিদ্যমান আইনি কাঠামোর ভেতরে থেকেই প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিটেন্স আনার কার্যক্রম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আর পরিশোধিত মূলধন বাড়ানোর জন্য নতুন করে অর্থ বিভাগের কাছে পত্র দিতে বলা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বড় দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে। রেমিটেন্স মোটা দাগে কমছে। গত বছর আড়াই শতাংশ কমেছে। এ বছর জুলাইয়ের পর থেকে ডাবল ডিজিট কমছে।
শুধু প্রবৃদ্ধি কমছে তা নয় পরিমাণও কমছে। এটি তেলের দাম কমছে এ জন্য হয়েছে তা বলা যাবে না। কারণ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকেও আমাদের রেমিটেন্স কমেছে। ফলে এই নেতিবাচক প্রভাব বিস্তৃত হচ্ছে। মনে রাখতে হবে রেমিটেন্স গ্রামীণ অর্থনীতির একটি বড় ধরনের চালিকা শক্তি।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.