সুদহার নিয়ে ষড়যন্ত্র অব্যাহত
ঋণের সুদের হার না কমানোর পক্ষে ষড়যন্ত্রকারীরা এখনও সক্রিয়। প্রভাবশালী মহলটির সদস্যরা সংশ্লিষ্ট সেক্টরের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে থাকায় কার্যত সুদের হার কমছে না।
অভিযোগ রয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে এদের কাছে সরকারও জিম্মি। এরা মূলত দেশে শিল্পায়ন চায় না। যে কারণে মন্দের ভালো হিসেবে সংসদীয় কমিটি আমানত ও ঋণের সুদহারের ব্যবধান বা স্প্রেড কমাতে সুপারিশ করলেও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। ওদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সংক্রান্ত সুপারিশও তথৈবচ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভারতসহ পার্শ্ববর্তী প্রায় সব দেশে সুদের হার সর্বোচ্চ ২ থেকে ৫ শতাংশ। অথচ এখানে স্প্রেডের ব্যবধান ৪ শতাংশে নামিয়ে আনার সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটি। বর্তমানে আমানতের সুদের হার ৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ (বাংলাদেশ ব্যাংকের মে মাসের হিসাব অনুযায়ী)। অর্থাৎ প্রায় ৬ টাকা। এর সঙ্গে স্প্রেড হিসেবে চার শতাংশ যুক্ত করলে সুদের হার দাঁড়াবে ১০ শতাংশ। যদিও বাস্তবে সুদের হার অনেক বেশি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে সুদহারের এই চিত্র খুবই হতাশাব্যঞ্জক। অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকারদের কয়েকজন যুগান্তরকে জানিয়েছেন, সত্য কথা বলতে গেলে সুদের হার নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। যাতে বাংলাদেশে শিল্প-কলকারখানা সফলভাবে গড়ে উঠতে না পারে সেজন্য দেশী ও বিদেশী একটি চক্র দীর্ঘদিন থেকে পর্দার আড়ালে নেতিবাচক ভূমিকা রেখে আসছে।
বাংলাদেশ যাতে শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে না পারে সেজন্য তারা সব সময় সুদের হার বেশি করে চাপিয়ে দিতে চায়। অনেক সময় এ চক্রের হস্তক্ষেপে দুর্নীতির মাধ্যমে ভুয়া প্রতিষ্ঠানকে বিপুল পরিমাণ ঋণ দেয়া হয়। আবার বড় ঋণখেলাপিকেও বড় ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে। উদ্দেশ্য হল, ঋণখেলাপির পরিমাণ বেশি হলে সুদের হার কমানো কঠিন হয়ে পড়ে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, ইউরোপের দেশগুলোতে সুদহার ৩ থেকে ৪ শতাংশ। ভারত-শ্রীলংকায় সুদহার সর্বোচ্চ ৪ থেকে ৫ শতাংশ। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে চাপিয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। সুপারিশ করতে পারে। তবে স্প্রেড ৪ শতাংশে নামিয়ে আনার সুপারিশকে ইতিবাচক সূচনা হিসেবে দেখছেন তিনি। কারণ দীর্ঘদিন সুদহার অনেক বেশি ছিল। আশা করা যায় ধীরে ধীরে সুদহার আরও কমবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাবেক আরেক এক ব্যাংকার বলেন, সুদহার নিয়ে সত্য কথা অনেকে বলতে চান না। তিনি মনে করেন, আসলে এ বিষয়ে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। কেউ কেউ মুক্তবাজার অর্থনীতির দোহাই দিয়ে সুদের হার মাফিয়াদের হাতে ছেড়ে দিতে চান। কিন্তু সরকারকে বুঝতে হবে, বেশি করে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে না উঠলে কোনো দেশ অর্থনৈতিক শক্তি অর্জন করতে পারে না।
সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ব্যাংকের স্প্রেড ৪ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার সুপারিশ করেছে। জানতে চাইলে স্থায়ী কমিটির সভাপতি ড. আবদুর রাজ্জাক যুগান্তরকে বলেন, সুদের হার যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনার জন্য সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সুপারিশ করেছে। কিছু ব্যাংক ঋণের সুদহার কমিয়েছে। কিন্তু প্রত্যাশা অনুযায়ী তারা সুদের হার কমায়নি।
পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল হালিম চৌধুরী শনিবার যুগান্তরকে বলেন, সুদহার অনেক কমেছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ না বাড়লে আরও কমে আসত। শুধু উচ্চমাত্রার খেলাপি ঋণের কারণে সুদহার যৌক্তিক পর্যায়ে কমানো যাচ্ছে না বলে মনে করেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, স্প্রেড নিয়ে পর্যালোচনা হচ্ছে। স্প্রেডসীমা যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনার বিষয়ে দ্রুতই উদ্যোগ নেয়া হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন মাসে ব্যাংক খাতে গড় স্প্রেড দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৮৫ শতাংশীয় পয়েন্টে। একইভাবে মে মাসে ৪ দশমিক ৯০ শতাংশীয় পয়েন্ট, এপ্রিলে ছিল ৪ দশমিক ৮৭ শতাংশীয় পয়েন্ট, মার্চে ৪ দশমিক ৮৬ শতাংশীয় পয়েন্ট ও ফেব্র“য়ারিতে ৪ দশমিক ৮১ শতাংশীয় পয়েন্ট ছিল। তবে এ সময়ে ব্যাংকিং খাতে গড় স্প্রেড ৫ শতাংশের নিচে অবস্থান করলেও বেসরকারি ও বিদেশী খাতের ব্যাংকগুলোর গড় স্প্রেড এখনও ৫ শতাংশীয় পয়েন্টের ওপরে রয়েছে। এ সময় সবচেয়ে বেশি স্প্রেড রয়েছে বিদেশী খাতের ব্যাংকগুলোর।
এদিকে সুদসীমা ৫ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনতে জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে ২৪টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীর কাছে চিঠি পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চিঠি পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে স্প্রেড কমিয়ে আনতে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এখনও অনেক ব্যাংক চিঠির জবাব দেয়নি। সে কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকের স্প্রেড বাড়া-কমা নিয়ে এতদিন উল্লেখযোগ্য কোনো তদারকি ছিল না। শুধু ৫ শতাংশের ওপরে স্প্রেড নেয়া যাবে না এমন একটা নির্দেশনা দেয়া ছিল। তবে তদারকির অভাবে প্রতি মাসেই ওই নির্দেশনা উপেক্ষিত হচ্ছে। দীর্ঘদিন পর স্প্রেড কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সংসদীয় কমিটির সুপারিশপত্রে ৮ মাসের সুদের চিত্র তুলে ধরা হয়। এতে দেখা যায়, ২০১৩ সালের জুন মাসে ব্যাংকগুলো গড়ে ৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহ করে ঋণ বিতরণ করে ১৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ সুদে। এ সময় গড় স্প্রেড দাঁড়ায় ৫ দশমিক ১৩ শতাংশ।
একইভাবে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলো গড়ে ৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহ করে ঋণ বিতরণ করে ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ সুদে। এ সময় গড় স্প্রেড দাঁড়ায় ৫ দশমিক ০৬ শতাংশ।
প্রায় অভিন্ন চিত্র ছিল ২০১৪ সালেও। সে বছরের জুন মাসে ব্যাংকগুলো গড়ে ৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহ করে ঋণ বিতরণ করে ১৩ দশমিক ১০ শতাংশ সুদে। এ সময় গড় স্প্রেড দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৩১ শতাংশ।
একইভাবে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলো গড়ে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহ করে ঋণ বিতরণ করে ১২ দশমিক ৪৬ শতাংশ সুদে। এ সময় গড় স্প্রেড দাঁড়ায় ৫ দশমিক ২১ শতাংশ। তবে ২০১৫ ও ১৬ সালে সুদের হার কিছুটা নিম্নুমুখী হয়। তবুও যৌক্তিক পর্যায়ে কমেনি।
সংসদীয় কমিটির ওই সুপারিশপত্রে আরও দেখা যায়, ২০১৫ সালের জুন মাসে ব্যাংকগুলো গড়ে ৬ দশমিক ৮০ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহ করে ঋণ বিতরণ করে ১১ দশমিক ৬৭ শতাংশ সুদে। এ সময় গড় স্প্রেড দাঁড়ায় ৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ।
একইভাবে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলো গড়ে ৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহ করে ঋণ বিতরণ করে ১১ দশমিক ১৮ শতাংশ সুদে। এ সময় গড় স্প্রেড দাঁড়ায় ৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ।
এ ধারা ২০১৬ সালেও অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি স্প্রেড ৪ শতাংশীয় পয়েন্টে নামিয়ে আনার সুপারিশটি করে।
সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সুপারিশপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, বেসরকারি ও বিদেশী বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর স্প্রেড তুলনামূলকভাবে বেশি।
মে মাসে ৯ বিদেশী ব্যাংকের মধ্যে ৫ বিদেশী ব্যাংকের স্প্রেড ৫ শতাংশের বেশি, যা ৫ দশমিক ১৩ শতাংশ থেকে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ। একই সময়ে বেসরকারি খাতের ৩৯টি ব্যাংকের ১৭টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের স্প্রেড ৫ শতাংশের পয়েন্ট ছাড়িয়েছে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.