আদ্দিকাল থেকেই বাংলায় হেমন্ত ঋতুতে কৃষকের ঘরে নতুন ফসল উঠলে আয়োজন করা হত পিঠা উৎসব। এই ধারাবাহিকতা চলত শীতকাল পর্যন্ত। এই পিঠা বাংলাদেশের সংষ্কৃতি আর ঐতিহ্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশের যে কোন উৎসবে আনন্দে মিশে আছে রকমারি পিঠা।
এই ধারাবাহিকতা চলত শীতকাল পর্যন্ত। এই পিঠা বাংলাদেশের সংষ্কৃতি আর ঐতিহ্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশের যে কোন উৎসবে আনন্দে মিশে আছে রকমারি পিঠা। সারা বছরই নানা উৎসবে পিঠা-পুলি খাই আমরা। পহেলা বৈশাখে নকশী পিঠা, গ্রীষ্মেকালে তালের পিঠা।
তবে শীতের সাথেই পিঠার সম্পর্ক নিবির। খেজুরের রস শীতের পিঠা খাওয়ার মজা আরো বাড়িয়ে দেয়। তবে নানা রকম বিদেশি খাবারের প্রাচুর্য্যের কারণে নতুন প্রজন্মের শহুরে নাগরিকরা অনেকেই অনেক পিঠা চেনে না বা এর আসল স্বাদ পায় না। বিশেষ করে প্রবাসে বেড়ে উঠা দ্বিতীয় প্রজন্মের কাছে এই পিঠা অনেকটাই অধরা। কিন্তু আশার কথা হচ্ছে, পিঠার এই ঐতিহ্য টিকে আছে এবং প্রবাসেও ছড়িয়ে পড়ছে। প্রবাসের বিভিন্ন সংগঠন এবং ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠির উদ্যোগে পিঠা উৎসব বা পিঠা মেলারও আয়োজন করছে। উত্তর আমেরিকা জুড়ে শীতে আয়োজন চলছে বর্নিল পিঠা উৎসবের। তারাই প্রবাসীদের পিঠার স্বাদ নেওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে। আর এরই মধ্য দিয়ে দেশের শহুরের মত প্রবাসেও প্রসার ঘটাচ্ছে আমাদের পিঠা সংস্কৃতির।
বাংলাদেশে ১৫০ বা তারও বেশী রকমের পিঠা থাকলেও মোটামুটি ৩০ প্রকারের পিঠার প্রচলন সবচেয়ে বেশি। নকশি পিঠা, চিতই পিঠা, রস পিঠা, ডিম চিতই পিঠা, দোল পিঠা, ভাপা পিঠা, পাটিসাপটা পিঠা, পাকান, আন্দশা, কাটা পিঠা, ছিট পিঠা, গোকুল পিঠা, চুটকি পিঠা, মুঠি পিঠা, জামদানি পিঠা, হাড়ি পিঠা, চাপড়ি পিঠা, পাতা পিঠা, ঝুড়ি পিঠা – এমনি আরও কত নাম!
পিঠা তৈরি হয় সাধারনত নতুন ধানের চালের গুড়া ও গুড় দিয়ে। অনেক সময় এর সঙ্গে দরকার হয় নারিকেল আর ভাজার জন্য তেল। কিছু পিঠায় সবজি ও মাংসের কুচি ব্যাবহার করা হয়। এধরনের কয়েকটি পিঠা হলো সবজি পুলি, সবজি ভাপা ও ঝাল বা মাংস পাটিসাপটা। তবে বর্তমানে ময়দা বা চিনি দিয়েও পিঠা তৈরি করা হচ্ছে। আর রস পিঠাগুলিতে খেজুরের রস ও দুধের ব্যবহারে স্বাদ বাড়িয়ে দেয় বহু গুন।
শীতকাল মানেই যেন পিঠা। তাই শীতকালকে আজ থেকে পিঠাকাল বললেও কেউ বোধহয় ভুল হবে না! শীত এলে তাই গ্রাম থেকে শহর অব্দি শুরু হয়ে যায় পিঠা বানানো আর খাওয়ার ধুম। আমাদের দেশের পিঠাগুলো কেবল খেতেই মজা নয় বরং এগুলোর নামগুলোও অনেক মজার।
তবে আজকাল পিঠা উৎসবে প্রতিযোগিতার কারনে আসল এবং ঐতিহ্যমন্ডিত পিঠার পাশাপাশি পিঠার নামে অনেক কিছুরি সংযোজন চলছে। যা ক্ষতিকর। তাই আয়োজকরা এবং বিচারকরা যদি এই বিষয়ে সচেতন না হন তবে আসল দেশীয় পিঠার বিষয়টি গৌন হয়ে যেতে পারে। প্রকৃত পক্ষে যেসব খাবার চালের গুড়া , গুড় কিংবা দুধ সহযোগে বানানো হয় সেগুলোই আসলে পিঠা বলা হয়। পিঠা বাঙালী তথা বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী খাবার। পিঠা বাঙালীর নিজস্ব খাবার।
শীতকালে যেসব পিঠা খাওয়ার ধুম পড়ে তার মধ্যে বেশি প্রচলিত পাকান বা তেল পিঠা, ভাপা পিঠা, পুলি পিঠা, চিতই পিঠা, পাটিসপ্তা, নকশি পিঠা, ফুল পিঠামাল পোয়া, রস পাকন।
ভাপা পিঠাঃ
চালের গুড়ার ভিতর গুড়ের মিশ্রনে গরম ভাপে যে পিঠাটি তৈরী করা হয় সেটাই ভাপা পিঠা নামে পরিচিত। বাংলাদেশে উত্তর বঙ্গ এবং দক্ষিন বঙ্গের পিঠার মধ্যে কিছুটা পার্থক্য থাকলেও ভাপা পিঠা বাংলার সব অঞ্চলেই দারুন জনপ্রিয়।
তেল পিঠা/পাকান পিঠাঃ
গরম তেলে গুড় গুলানো চালের আটা ছেড়ে দিলে ফুলে ওঠে যে পিঠা সেটাই তেল পিঠা। অনেক এলাকায় একে পাকান পিঠাও বলে।
চিতই পিঠাঃ
আরো আছে চিতই পিঠা। চালের গুড়া পানিতে গুলিয়ে মাটির হাঁড়িতে ছেড়ে দিলেই তৈরী হয়ে যায় চিতই পিঠা। সাদাসিধে এই পিঠা গুড় কিংবা ঝাল চাটনি দিয়ে খেতে খুবই মজা। এই চিতই পিঠাকেই সারা রাত দুধ-গুড়ের রসে ভিজিয়ে রাখলে সকাল বেলা দুধ পিঠা বা রস পিঠা তৈরি হয়ে যায়। নকশি পিঠাঃ আরেকটি চমৎকার পিঠা হলো নকশি পিঠা। এই পিঠার গায়ে বিভিন্ন ধরণের নকশা আঁকা হয় কিংবা ছাঁচে ফেলে পিঠাকে নানা রকম নকশার আদলে তৈরি করা হয় বলেই এই পিঠার নামটি এমন। নকশি পিঠা তৈরীর জন্য প্রথমে আতপ চালের গুড়া বা আটা সেদ্ধ করে মন্ড তৈরি করা হয়। এই মন্ড বেলে রুটি করে তার উপর গাছ, লতা-পাতা, ফুল ইত্যাদি নকশা করা হয়। খেজুর কাঁটা, খোঁপার কাঁটা, সুঁচ, পাট কাঠি, খড়কা ইত্যাদিও সাহায্যেও পিঠার গায়ে নকশা তোলা হয়। হাতের বদলে ছাঁচ দিয়েও পিঠায় নকশা আঁকা হয়। ছাঁচগুলি সাধারনত মাটি, পাথর, কাঠ বা ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরী। এসব ছাঁচের ভিতরের দিকে গাছ, ফুল, লতা, পাতা, মাছ, পাখি- ইত্যাদি নকশা আঁকা থাকে।
ফুল পিঠাঃ
নকশি পিঠার মতো দেখতে ফুল পিঠা। কিন্তু নকশি পিঠার চেয়ে কিছুটা নরম হয় এই পিঠাটি।
পাটিসাপটাঃ
গুড় দিয়ে তৈরী হালকা বাদামী অথবা চিনির সাদা পাটিসাপটা আরেকটা সুস্বাদু পিঠা।
মাল পোয়া আর ঝিকিমিকি পিঠাঃ
মাল পোয়া আর ঝিকিমিকি পিঠা বানানো হয় শুকনো চালের গুড়ো ও চিনি দিয়ে। দুটোই মজাদার পিঠা।
রস পাকনঃ
শীতের ঐতিহ্যবাহী আরও কিছু পিঠা হলো রস পাকন। রস পাকান তৈরী হয় শুকনো সুজি, ডিম আর চিনি দিয়ে। এর স্বাদ সে কারণেই ভারি মিষ্টি।
কুলি পিঠাঃ
কুলি পিঠা বানাতে দরকার শুকনো চাউলের গুড়ো, দুধ এবং নারকেল। কুলি পিঠা বেশ জনপ্রিয়। ভিন দেশের অন্য পিঠা সীমিত অর্থে যেসব খাবার চালের গুড়া ও গুড় দিয়ে বানানো হয় তাকেই পিঠা বলে। কিন্তু বর্তমানে ময়দা বা আটা ও চিনি ও অন্যান্য উপাদান দিয়েও পিঠা বানানো হচ্ছে। ফলে ইউরোপ আমেরিকা ও বিশ্বের অন্যান্য কিছু দেশের খাবারকেও পিঠা হিসেবে চিহ্নিত করা চলে। সে অর্থে পিঠা আমাদের দেশের প্রাচীন এক ঐতিহ্য হলেও পিঠা খাওয়ার এই রেওয়াজ শুধু আমাদের নয়। ভারত, নেপাল, ভুটান, তিব্বত, ইউরোপ, আমেরিকা সহ আরও অনেক দেশেই রয়েছে এই ধরনের খাবারের প্রচলন ।
এসব দেশের পিঠাগুলো ঠিক আমাদের দেশের পিঠাগুলোর মত নয়। এ গুলো তৈরির প্রক্রিয়া আর খাওয়ার রেওয়াজের মধ্যেও রয়েছে বেশ ভিন্নতা। পিঠা খাওয়ার বিষয়টি আমাদের এই উপমহাদেশে যেরকম উৎসবের আমেজ পায় পশ্চিমা দেশগুলোতে ঠিক সেরকম হয় না। পশ্চিমা দেশগুলোতে এ গুলোকে প্যান কেক বা রাইস কেক ও আরও অনেক নামে চিহ্নিত করা হয়। এই পিঠাগুলি শুধু ময়দা আর পানি মিশিয়ে তৈরি করা হয়। এছাড়া অনেক সময় ঈষ্ট, বেকিং পাউডার ইত্যাদি মিশ্রিত করা হয়।
ইংরেজি কেক শব্দের অর্থ বাংলায় পিঠা করা হলেও ইংরেজি পিঠার সঙ্গে বাঙালির পিঠার যোজন যোজন ফারাক। ইংরেজি পিঠা আমাদের পিঠার স্বাদ, গন্ধ থেকে একেবারেই আলাদা। মেক্সিকোতে প্যানকেকে ময়দার পরিবর্তে ভুট্টার আটা ব্যবহার করা হয়। জনপ্রিয় এই হটকেক বা প্যানকেক মেক্সিকোর রেস্টুরেন্টে প্রচুর পরিমানে বিক্রি হয়। সে দেশের ফুটপাতেও হটকেক ব্যাপকভাবে বিক্রি হতে দেখা যায়।
অষ্ট্রেলিয়ার প্যানকেক আমেরিকার মতোই। নাস্তা হিসেবে এর বেশ কদর সে দেশে লক্ষ করা যায় । ময়দা, ডিম ও দুধ এই তিন ধরনের উপাদান দিয়েই প্যানকেক তৈরি করা হয় ইংল্যান্ডে। তবে এই প্যানকেক আমেরিকার প্যানকেকের চেয়ে আলাদা। স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডে প্যানকেকের আঞ্চলিক নাম গ্রিডল কেক।
ফ্রান্সের পিঠা বা প্যানকেককে বলা হয় ক্রপেস (crepes)। এই বিশেষ খাবার শুধু ফান্সেই নয় ব্রাজিল ও কানাডাতেও সমানভাবে জনপ্রিয়। এই খাবারটিও ময়দা, দুধ ও ডিম দিয়ে বানানো হয় এবং সাধারণত মিষ্টি (ফল, আইসক্রিম) কোন কিছু দিয়ে খাওয়া হয়।
জার্মানির প্যানকেকগুলি ব্রিটেনের মতোই। অনেক অঞ্চলে এই খাবারকে পানকোখেন (Pfannkuchen) বলা হয়। কোথাও কোথাও একে এ্যরকোখেন (Eierkuchen) বলা হয়। অস্ট্রিয়াতে প্যানকেককে পালাশচিনকেন (Palatschinken ) নামে ডাকা হয়। তারা প্যানকেকের মধ্যে জ্যাম, চকোলেট সস, হেজেলনাট ভরে খায়।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.